এলসি-কি

আমদানি রপ্তানি ব্যবসার সাথে এলসি নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেসব নিরাপদ পেমেন্ট পদ্ধতি আছে তার মধ্যে এলসি হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি। কারণ এলসি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। আর আমরা সবাই জানি যে ব্যাংক হচ্ছে একটা নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এখানে সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয় একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।এজন্য ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে লেনদেন করা অনেক বেশি নিরাপদ। চলুন আবার এলসি কি, এলসির সাথে জড়িত পক্ষসমূহ এবং এলসির প্রকারভেদ নিয়ে জেনে নিই।

এলসি কি?

এলসি (LC) শব্দটি লেটার অব ক্রেডিটের সংক্ষিপ্ত রুপ। এলসি হচ্ছে  আমদানিকারকের পক্ষ হয়ে ইস্যুকারী ব্যাংক কর্তৃক রপ্তানিকারকে একটি নিশ্চয়তা যার মাধ্যমে ব্যাংক রপ্তানিকারককে এই বলে নিশ্চয়তা প্রদান করে যে যদি রপ্তানিকারক সকল শর্ত পূরণ করে তাহলে ব্যাংক যথাসময়য়ে পণ্যমূল্য পরিশোধ করবে।

এলসি’র সাথে যেসব পক্ষ জড়িত  

এলসির সাথে যেসব পক্ষসমূহ জড়িত সেগুলো নিম্নরূপ –

১. আমদানিকারক / ক্রেতা / অ্যাপ্লিক্যান্ট

২. রপ্তানিকারক / সরবরাহকারী / বিক্রেতা / সুবিধাভোগী

৩. এলসি ইস্যুকারী ব্যাংক

৪. এলসি অ্যাডভাইসিং ব্যাংক

৫. এলসি কনফার্মিং ব্যাংক ( যদি প্রয়োজন হয়)

৬.  নমিনেটেড ব্যাংক / নেগশিয়েটিং ব্যাংক (Nominated Bank/Negotiating Bank)

৭. রিইমবার্সিং ব্যাংক / পেয়িং ব্যাংক  (Reimbursing/Paying Bank)

আমদানিকারক / ক্রেতা / অ্যাপ্লিক্যান্ট – যিনি পণ্য আমদানি করার উদ্দেশ্যে এলসি খোলার জন্য ব্যাংকের কাছে আবেদন করেন।

রপ্তানিকারক / সরবরাহকারী / বিক্রেতা / সুবিধাভোগী –  যিনি পণ্য রপ্তানি করেন এবং যিনি এলসি’র প্রকৃত সুবিধাভোগী।

এলসি ইস্যুকারী ব্যাংক – যে ব্যাংক পণ্য আমদানিকারকের অনুরোধে এলসি খোলে থাকে।

এলসি অ্যাডভাইসিং ব্যাংক – এলসি ইস্যুকারী ব্যাংক এলসি অ্যাডভাইসিং ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি’র সুবিধাভোগীর কাছে এলসির অর্থ প্রদান করে থাকেন।

এলসি কনফার্মিং ব্যাংক – অনেক সময় রপ্তানিকারকের চাহিদা অনুযায়ী নতুন একটি ব্যাংককে এলসি প্রক্রিয়াতে যুক্ত করতে হয়। রপ্তানিকারক যাতে এলসির অর্থ যথাসময়য়ে পায় সে বিষয়টা কনফার্মিং ব্যাংক তদারক করে থাকে।

নমিনেটেড ব্যাংক / নেগশিয়েটিং ব্যাংক – এই ব্যাংক পণ্য রপ্তানিকারকের পক্ষ হয়ে এলসি প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত সকল ডকুমেন্ট যাচাই করে এবং শর্তসমূহ সঠিকভাবে পালন করা হয়েছে কিনা তা চেক করে থাকে যার ফলে ডিস্ক্রিপেন্সি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

রিইমবার্সিং ব্যাংক / পেয়িং ব্যাংক – এই ব্যাংক ইস্যুকারী ব্যাংকের পক্ষ হয়ে রপ্তানিকারককে এলসির অর্থ পরিশোধ করে থাকে।

এলসি অ্যাডভাইসিং ব্যাংক এবং রিইমবার্সিং ব্যাংক ক্ষেত্রে বিশেষে এক হতে পারে আবার আলাদাও হতে পারে।

আরও পড়ুন – চীন থেকে পণ্য আমদানি করবেন কিভাবে?

এলসি’র প্রকারভেদ

উপরে এলসি কি এবং এর সাথে জড়িত পক্ষসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। এবার আমি এলসির প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করব।

এলসি বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। এর মধ্যে কতগুলো হচ্ছে –

  • পেমেন্ট এট সাইট এলসি (Payment at Sight LC)

  • ডেফার্ড পেমেন্ট এলসি (Deferred Payment LC)

  • রিভলভিং ক্রেডিট এলসি (Revolving Credit LC)

  • ইররেভোকেবল এলসি (Irrevocable LC)

  • রিভোকেবল এলসি (Revocable LC)

  • স্ট্যান্ড বাই এলসি (Stand-by LC) .

  • রেড ক্লজ এলসি (Red Clause LC)

  • গ্রীন ক্লজ এলসি (Green Clause LC)

  • ব্যাক টু ব্যাক এলসি (Back-to-Back LC)

  • ইউপাস এলসি ( UPAS LC)

পেমেন্ট এট সাইট এলসি – সাইট এলসির শর্ত হচ্ছে শিপমেন্টের ২১ দিন পর পেমেন্ট পরিশোধ করা বা বিল অব এন্ট্রিসহ রপ্তানি সঙ্ক্রান্ত ডকুমেন্ট পেয়ে যাওয়ার ৫ দিনের মধ্যে পেমেন্ট পরিশোধ করে দিতে হবে। তবে যদি ডকুমেন্টে ডিস্ক্রিপেন্সি বা সমস্যা থাকে তাহলে তা আবার রপ্তানিকারকের ব্যাংকে সংশোধনের জন্য পাঠানো হয়।

ডেফার্ড পেমেন্ট এলসি – এই এলসির শর্ত অনুযায়ী ডকুমেন্ট জমা দেয়ার পর পরই ব্যাংক পেমেন্ট পরিশোধ করবে না। এলসিতে উল্লেখ করা পরবর্তী সময়ের মধ্যে পেমেন্ট পরিশোধ করতে হবে। যেমন এলসিতে বলা থাকতে পারে ডকুমেন্টস পাওয়ার ১২০ দিন পর পেমেন্ট পরিশোধ করতে হবে। তাহলে ব্যাংক ডকুমেন্টস পাওয়ার ১২০ দিন পর এলসির অর্থ পরিশোধ করবে।

রিভোলভিং ক্রেডিট এলসি – এই এলসির আওতায় আবেদনকারীএকটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ঋণ পায় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেটি ব্যবহার করা যায়। এলসির আবেদনকারী যখন লিমিট অতিক্রম করে তখন আবার ব্যাংক থেকে পুনরায় সমপরিমাণ ঋণ পেয়ে থাকে।

ইররেভোকেবল এলসি – যে এলসির শর্ত পরিবর্তন করা যায় না। তবে ব্যাংক, আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারক সবাই মিলে চাইলে শর্ত পরিবর্তন করা যায়।

রিভোকেবল এলসি – এই এলসির শর্ত ব্যাংক চাইলে পরিবর্তন করতে পারে।

স্ট্যান্ড বাই এলসি – স্ট্যান্ড বাই এলসি হচ্ছে এক ধরণের লিগেল ডকুমেন্ট যার মাধ্যমে ক্রেতার ব্যাংক বিক্রেতাকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। যদি ক্রেতা কোন কারণে পেমেন্ট পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ব্যাংক তা পরিশোধ করবে।

রেড ক্লস এলসি – যদি কোন এলসিতে শর্ত থাকে যে পণ্য জাহাজীকরণের আগেই পেমেন্ট পরিশোধ করতে হবে এবং সেটা লাল কালি দিয়ে এলসির উপর লেখা থাকে তখন তাকে রেড ক্লজ এলসি বলা হয়। এই ধরণের এলসি আমাদের দেশে সাধারণত হয় না।

গ্রীন ক্লজ এলসি – গ্রীন ক্লজ এলসি হচ্ছে রেড ক্লজের বর্ধিত রুপ। গ্রীন এলসি ক্লজের উপরে সবুজ রঙ দিয়ে দিয়ে কিছু বিষয় লেখা থাকে। এলসি ইস্যুকারী ব্যাংক এই এলসির অর্থ শিপমেন্টের পূর্বে রপ্তানিকারককে পরিশোধ এবং রপ্তানিকৃত পণ্য যথাযত স্টোরেজের জন্য নেগোশিইয়েটিং ব্যাংকের সাথে চুক্তি করে।

ব্যাক টু ব্যাক এলসি – যখন আমদানিকারক রপ্তানিকারকের বরাবর এলসি ইস্যু করে তখন তাকে মাস্টার এলসি বলে। এই মাস্টার এলসির বিপরীতে যে এলসি খুলা হয় তাকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি বলে। এই এলসির মাধ্যমে রপ্তানিকারক পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করে থাকে।

ইউপাস এলসি – UPAS (Usance but Payable At Sight)  LC এলসি হচ্ছে বিশেষ ধরণের এলসি যা ব্যাংক তার বিশ্বস্ত ক্লায়েন্টদেরকেই শুধু ইস্যু করে থাকে। এর মাধ্যমে ব্যাংক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে অর্থ না পেলেও এলসির পেমেন্ট ডকুমেন্ট পাওয়ার সাথে সাথেই রপ্তানিকারকে দিয়ে দেয়। ব্যাংক তার ক্লায়েন্টের উপর কমিশন ধার্য করে থাকে। অন্যদিকে ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ক্লায়েন্টকে অর্থ পরিশোধের সুযোগ দেয়।

আরও পড়ুনআমদানি-রপ্তানি ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন তার গাইডলাইন

পরিশেষে 

আশা করি এই আর্টিকেল পড়ার পর এলসি কি, এলসির প্রকারভেদ এবং এলসির সাথে জড়িত পক্ষসমূহ সম্পর্কে আপনারা পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন। বৈদেশিক বাণিজ্যে এলসি সম্পর্কে এই জ্ঞান আপনাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করবে তা আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।

বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল বাংলাদেশের প্রথম গবেষণাধর্মী একটি বিজনেস ব্লগ। আমরা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইডিয়া, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের লেখা এবং পরামর্শ যদি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে থাকে তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here