ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য যে বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হবে

বর্তমানে নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে ই-কমার্স একটি চমকপ্রদ বিষয়। বেকার থেকে শুরু করে অনেক চাকরিজীবীও এখন ই-কমার্স ব্যবসায়ের দিকে ঝুঁকছে।

এই প্রবণতার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা। দেশের বিরাট একটা জনগোষ্ঠী এখন ইন্টারনেটের আওতায় এসেছে। অনলাইনে মানুষ দিনের একটা অংশ ব্যয় করছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে টার্গেট করে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এবং প্রচুর পরিমাণে পণ্য বিক্রি করছে।

তবে অনলাইনে ব্যবসা করে প্রচুর আয় করছে এরকম ব্যবসায়ীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী পণ্য আশানুরূপ পণ্য বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়। যথাযত কৌশল প্রয়োগ করতে না পারাই এই ব্যর্থতার পেছনে অন্যতম কারণ। তাই ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই কিছু বিষয় অনুসরণ করতে হবে।

ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য যে ১০ টি বিষয় অনুসরণ করতে হবে 

১. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ 

ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য আপনাকে গ্রাহকদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। গ্রাহকদের সন্তুষ্টি অর্জন করার একটি বড় উপায় হচ্ছে নির্ধারিত সময়ে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা।

আপনি নিজে একজন ক্রেতা হিসেবে চিন্তা করে দেখেন। আপনি একটি শার্ট ক্রয় করার জন্য অনলাইনে অর্ডার করলেন, তারা আপনাকে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে সেই শার্ট সরবরাহ করবে বলল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে শার্ট সরবরাহ করল না। তখন আপনি অবশ্যই বিরক্ত হবেন এবং এদেরকে দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করে আর কখনো এই প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু কেনার জন্য অর্ডার করবেন না।

তাই গ্রাহক ধরে রাখার জন্য আপনাকে অবশ্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। যদি নির্ধারিত সময়ের আগে পৌঁছাতে পারেন তাহলে তো খুবই ভাল। তবে কোন কারণে দেরি হয়ে গেলে গ্রাহকদের কাছে দেরি হওয়ার কারণ উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করে ভবিষ্যতে সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিবেন।

আরো পড়ুনঃ ই-কমার্স ব্যবসা কি? কিভাবে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন?

২. ভাল কোয়ালিটির পণ্য সরবরাহ করুন  

সস্তা এবং মানহীন পণ্যের দিন শেষ। গ্রাহকরা এখন ভাল কোয়ালিটির পণ্যের খোঁজ করে। পণ্যের কোয়ালিটি যদি ভাল হয় তাহলে দাম বেশি দিতেও গ্রাহকদের আপত্তি থাকে না। ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য অবশ্যই গ্রাহকদের ভাল পণ্য দিতে হবে। আপনি যদি ভাল গুনাগুণ সম্পন্ন পণ্য বিক্রি করেন তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে আপনি লাভবান হবেন।

৩. ওয়েবসাইট তৈরি করা

যে কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়েবসাইট থাকা খুবই জরুরী। কারণ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আপনার পণ্যগুলো খুব সুন্দরভাবে ক্যাটাগরি অনুযায়ী গ্রাহকদের সামনে প্রদর্শন করতে পারবেন। গ্রাহকরাও তাদের কাঙ্ক্ষিত পণ্য ক্যাটাগরি দেখে সহজেই খুঁজে বের করে অর্ডার করতে পারবে।

একটি প্রফেশনাল ওয়েবসাইট আপনার ব্যবসায়ের ব্র্যান্ড ভেলু অনেক বাড়িয়ে দিবে। তাই ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করার সময় একটি ওয়েবসাইট বানিয়ে নিন। একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট বানাতে খুব বেশি খরচ হয় না, ১৫-২৫ হাজার টাকার মধ্যেই আপনি একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট বানাতে পারবেন। আর নিজে যদি বানাতে পারেন তাহলে আপনার এই খরচটা বেঁচে যাবে। হোস্টিং যাতে ভাল হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন কারণ এর উপর ওয়েবসাইটের পারফর্মেন্স নির্ভর করবে।

এক্ষেত্রে দেশের বাইরে থেকে ভাল কোম্পানির হোস্টিং নিতে পারলে আপনার ব্যবসার জন্য খুব ভাল হবে। যেমনঃ আপনি Bluehost বা Hostgator থেকে হোস্টিং নিতে পারেন। তবে এগুলো একটু ব্যয়বহুল। মাসে ৩০০০-৩৫০০ টাকার মতো খরচ হবে। আর Namecheap থেকে ডোমেইন এবং হোস্টিং নিলে আপনার খরচ একটু কম পড়বে। সার্ভিসের দিক দিয়ে Bluehost বা Hostgator থেকে একটু পিছিয়ে থাকলেও খারাপ বলা যাবে না। আর যদি দেশের কোম্পানি থেকে নিতে চান তাহলে dianahost থেকে নিতে পারেন। এরা বেসিসের সদস্য এবং দীর্ঘদিন সুনামের সাথে ব্যবসা করছে। তাই তাদের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে ই-কমার্সের সম্ভাবনা ও সমস্যা

৪. ফেইসবুক পেইজ

ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য ফেসবুকে পেইজ থাকতেই হবে। ফেসবুকে পেইজ না থাকলে গ্রাহকের কাছে আপনার পণ্য প্রমোট করতে পারবেন না। ফেসবুকে মাত্র কয়েক ডলার খরচ করেই আপনি বিরাট সংখ্যক টার্গেট গ্রাহকের কাছে আপনার পণ্যের বিজ্ঞাপন পৌঁছে দিতে পারবেন যা প্রচলিত মিডিয়াতে সম্ভব নয়। প্রচলিত মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পুষাতে পারবে না। তবে বড় বিনিয়োগকারীদের হিসাব আলাদা। তারা তাদের পণ্যের ব্যাপক প্রচারের জন্য অনলাইন এবং অফলাইন দুই মাধ্যমই ব্যবহার করে।

ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে লাইভে এসে আজকাল অনেক নারী উদ্যোক্তারা তাদের হাতে তৈরি জামাকাপড় বিক্রি করছে। তারা সাড়াও পাচ্ছে বেশ ভাল। তাই আপনার যদি উপস্থাপনায় দক্ষতা থাকে তাহলে আপনি ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে আপনার প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।

আরো পড়ুনঃ ২০২১ সালের জন্য ৮০ টি লাভজনক ব্যবসার আইডিয়া

৫. ব্যবসায়ের সাথে সঙ্গগতিপূর্ণ সুন্দর একটি নাম রাখুন

যে কোন ব্যবসায়ের জন্য নাম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। মানুষ সহজেই মনে রাখতে এরকম আকর্ষণীয় নাম নির্বাচন ব্যবসায়ের সফলতায় ভূমিকা পালন করে। যে নামটি দিবেন সেটি আপনার ব্যবসায়ের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। কারণ ব্যবসায়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন নাম মানুষ সহজে মনে রাখতে পারে না।

নাম নির্বাচনের সময় আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আপনি যে নামটি নির্বাচন করবেন সেই নামে ডোমেইন অ্যাভেইলেবল আছে কিনা তা যাচাই করে নিবেন। কারণ আপনাকে এই নাম দিয়েই একটি ডোমেইন কিনতে হবে।

৬. ব্যবসায়িক সততা

ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য ব্যবসায়িক সততা একটা বিরাট ফ্যাক্টর। কারণ আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ই-কমার্স সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা আছে। অনেকেই মনে করে অনলাইন থেকে পণ্য কিনলে তার কোয়ালিটি ভাল থাকে না এবং অনেক সময় গ্রাহকরা অর্ডার অনুযায়ী তাদের পণ্য বুঝে পায় না। তাই ই-কমার্স ব্যবসায় গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি যদি গ্রাহকদের নির্ধারিত সময়ে ভাল কোয়ালিটির পণ্য সরবরাহ করতে পারেন তাহলে আপনি ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হবেন একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

আপনাকে মনে রাখতে হবে গ্রাহকদের নেগেটিভ রিভিও আপনার ব্যবসায়ের জন্য হুমকি। নেগেটিভ রিভিও সম্ভাব্য গ্রাহকদের আস্থা নষ্ট করে ফেলে এবং ব্যবসায়ীক ক্ষতির কারণ হয়।

৭. ভাল কাস্টমার সার্ভিস

ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য কাস্টামার সার্ভিস ভাল হতে হবে। গ্রাহকরা যাতে তাদের প্রশ্ন বা অভিযোগের উত্তর পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন কোন গ্রাহক পণ্য পাওয়ার পর যদি অভিযোগ করে তিনি তার অর্ডার করা পণ্যের সাইজ বা রঙ আপনার ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত পণ্যের সাথে মিলে না তখন অবশ্যই আপনাকে সেই অভিযোগ আমলে নিতে হবে। গ্রাহকের অভিযোগের নিষ্পত্তি করে পণ্য ফেরত নিতে হবে এবং পুনরায় নতুন পণ্য পাঠাতে হবে।

কোন গ্রাহক পণ্যের ব্যাপারে কোন কিছু জানতে চাইলে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এমনভাবে উত্তর দিতে হবে যেন গ্রাহক সেই পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে এবং সেটি ক্রয় করতে উৎসাহিত হয়।

গ্রাহক সেবা প্রদান করার জন্য ইমেইল, মোবাইল এবং চ্যাটিং এর ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে তাৎক্ষণিক সেবা প্রদান করা যায়।

৮. ব্যতিক্রমী পণ্য বিক্রয়

মানুষ এখন ব্যতিক্রম বা নতুন পণ্যের স্বাদ নিতে চায়। মানুষের এই চাহিদাকে পুঁজি করে অনেক কোম্পানি বিভিন্ন ধরণের নতুন পণ্য বাজারে আনার চেষ্টা করছে। আপনিও যদি নতুন বা ব্যতিক্রম কোন পণ্য বাজারে নিয়ে আসতে পারেন তাহলে গ্রাহকদের খুব ভাল সাড়া পাবেন। কিন্তু গতানুগতিক পণ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তাহলে বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।

৯. ব্যবসায়ের লাইসেন্স থাকা

যদিও আমাদের দেশে ই-কমার্স ব্যবসায়ের জন্য এখনো লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করে নাই তবুও লাইসেন্সের একটা মূল্য আছে। লাইসেন্স করা থাকলে গ্রাহকরা আপনার প্রতিষ্ঠানকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করবে। লাইসেন্স থাকলে আপনি একটা আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে চলবেন যা আপনার ব্যবসায়ের প্রতি আপনাকে আরও বেশি দায়িত্ববান করে তুলবে। আর আপনি ব্যবসায়ের প্রতি যত বেশি দায়িত্ববান হবেন তত বেশি আপনি সফল হবেন।

১০. টার্গেট গ্রাহক চিহ্নিত করা

আপনি যদি শার্ট বিক্রি করেন তাহলে আপনার টার্গেট গ্রাহক হবে ছেলে। থ্রিপিস, গহনা, সালোয়ার বিক্রি করলে টার্গেট গ্রাহক হবে মেয়ে। শাড়ি বিক্রি করলে টার্গেট গ্রাহক হবে মধ্যবয়স্ক মহিলা। ছোটদের পোশাক বিক্রি করলে টার্গেট গ্রাহক হবে বাচ্চা। এগুলো উদাহরণ হিসেবে বললাম।

প্রত্যেকটা পণ্যের গ্রাহক আলাদা। আপনার ব্যবসা শুরু করার আগে গ্রাহক নিয়ে গবেষণা করতে হবে। আপনার পণ্যের প্রকৃত গ্রাহক কারা তা চিহ্নিত করতে হবে। গ্রাহক অনুযায়ী আপনার বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইন এবং কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে যাতে আপনার পণ্য সম্পর্কে বার্তা উপযুক্ত গ্রাহকের কাছে পৌঁছায়। আপনি যদি প্রকৃত গ্রাহকের কাছে না পৌঁছাতে পারেন তাহলে আপনার ব্যবসা সফলতার মুখ দেখবে না। সফল হওয়ার জন্য টার্গেট গ্রাহক চিহ্নিত করে তাদের কাছে পণ্যের বিজ্ঞাপন পোঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

উপসংহার

আশা করি ই-কমার্স ব্যবসায়ে সফল হওয়ার জন্য যে সব বিষয় অনুসরণ বা মেনে চলা উচিৎ সে সম্পর্কে একটি ভাল ধারণা পেয়েছেন। যথেষ্ট গবেষণা করে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালভাবে জেনে তারপর এই পরামর্শগুলো দেওয়া হয়েছে। এখন আপনার কাজ হচ্ছে এসব বিষয় সিরিয়াসভাবে নিয়ে আপনার ব্যবসায়ে বাস্তবায়ন করা। পরিশেষে, আপনার ব্যবসায়ের সফলতা কামনা করছি।

বিঃদ্রঃ এই ওয়েবসাইটের কোন ছবি বা লেখার অংশবিশেষ আপনার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে চাইলে অবশ্যই bdbusinessjournal.com নামটি ম্যানশন করে দিবেন। অন্যথায় সেটি কপিরাইট আইন লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল বাংলাদেশের প্রথম গবেষণাধর্মী একটি বিজনেস ব্লগ। আমরা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইডিয়া, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের লেখা এবং পরামর্শ যদি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে থাকে তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here