কিভাবে এলসি খুলতে হয়

আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে এলসি একটি পরিচিত নাম। কারণ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যতগুলো মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি আছে তার মধ্যে এলসি হচ্ছে নিরাপদ মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি। কারণ এলসির প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। এলসির খোলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যকেটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। ব্যাংক প্রথমে আপনার সক্ষমতা বিবেচনা করে এলসি খুলবে এবং যথাযথ ডকুমেন্ট প্রাপ্ত হলেই এলসির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিবে। চলুন কিভাবে এলসি খুলতে হয় সে ব্যাপারে জেনে নেয়া যাক।

এলসি কি? 

এলসি হচ্ছে আমদানিকারীর ব্যাংক কর্তৃক একটি আন্ডারটেকিং বা নিশ্চয়তা যার মাধ্যমে ব্যাংক রপ্তানিকারকে মূল্য পরিশোধের নিশ্চয়তা প্রদান করে তবে এক্ষেত্রে রপ্তানিকারকে অবশ্যই সকল শর্ত পূরণ করতে হবে।

এলসি খোলার জন্য একজন আমদানিকারকের যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়

আপনি চাইলেই এলসি খুলতে পারবেন না। এজন্য আপনাকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে।

যিনি এলসি খুলতে যাবেন তাকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে সুপরিচিত হতে হয়। যদি আপনি ব্যাংকের কাছে সুপরিচিত না হোন তাহলে ব্যাংক অন্য উৎস থেকে আপনার অতীত ইতিহাস জেনে নিবে।

এলসি খুলার জন্য আপনাকে যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে –

    • পূর্বের কোন বিল অব এন্ট্রি বকেয়া থাকতে পারবে না।

    • আপনার CIB রিপোর্ট অবশ্যই ভাল হতে হবে। ( নোট – CIB হচ্ছে Credit Information Bureau। বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে সকল ঋণগ্রহীতার ঋণের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে থাকে)

  • বিগত কয়েক বছরে স্বচ্ছ লেনদেনের ইতিহাস থাকতে হবে।

  • ব্যাংক হিসাব খোলার সময় সকল তথ্য ভালভাবে দিতে হবে।

আরও পড়ুন- এলসি কি? এলসির সাথে জড়িত পক্ষসমূহ কারা?

কিভাবে এলসি খুলতে হয়?

এলসি খোলার জন্য আপনাকে কিছু ডকুমেন্ট নিয়ে ব্যাংকে যেতে হবে। প্রায় সব ব্যাংকেই একই ধরণের ডকুমেন্ট চায়। তবে কিছু ব্যাংক অতিরিক্ত কিছু ডকুমেন্ট চাইতে পারে। সাধারণত এলসি খোলার জন্য ব্যাংক যেসব ডকুমেন্ট আপনার কাছ থেকে চাইবে সেগুলো হচ্ছে –

  • হালনাগাদ করা বৈধ ট্রেড লাইসেন্স

  • বৈধ আইআরসি (IRC)

  • টিআইএন (TIN) সার্টিফিকেট

  • ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট

  • কোন স্বীকৃত চেম্বার/ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য পদের সনদপত্র

  • জাতীয় পরিচয় পত্র

  • আরজেএসসি থেকে রেজিস্ট্রেশনের সার্টিফিকেট (লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে)

  • সার্টিফিকেট অব ইনকর্পোরেশন (লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে)

  • মেমোরেন্ডাম এবং আর্টিকেল-অব-এসোসিয়েশন (লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে)

  • অংশীদারি চুক্তিপত্রের সার্টিফিকেট ( অংশীদারি ব্যবসার ক্ষেত্রে)

  • রেজুলেশন

  • পরিচালকদের পরিচিতি পত্র

  • বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্স (প্রয়োজন হলে)

  • ফায়ার লাইসেন্স

  • কারখানা ভাড়ার চুক্তিপত্র বা মালিকানা দলিল

  • প্রফোরমা ইনভয়েজ

  • কারখানা পরিদর্শন সার্টিফিকেট

  • ড্রাগ লাইসেন্স ( ঔষধ কোম্পানির ক্ষেত্রে)

  • ইনস্যুরেন্স

  • ১ সেট সত্যায়িত চার্জ ডকুমেন্ট ( ব্যাংক কর্তৃক সরবরাহকৃত)

  • স্বাক্ষরসহ ফাঁকা চেকের পাতা

  • জামানতের ডকুমেন্ট

  • সম্পদ-দায়ের বিবরণী

এলসির আবেদনের সাথে এসব ডকুমেন্ট আপনাকে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। যেহেতু ব্যাংক ভেদে ডকুমেন্ট কম বা বেশি হতে পারে তাই আপনাকে এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে গিয়ে ভালভাবে জেনে নিতে হবে।

আরও পড়ুন- আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন তার গাইডলাইন

এলসি খোলার জন্য কিভাবে আবেদনপত্র লিখবেন?

এলসি খোলার জন্য আপনাকে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার ম্যানেজার বরাবর একটি আবেদন পত্র লিখতে হবে। এলসির আবেদনপত্র লেখার কিছু নিয়ম কানুন আছে যা আপনাকে পালন করতে হবে। এলসির আবেদনপত্র লেখার সময় প্রফোরমা ইনভয়েজ, আমদানি পলিসি আদেশ, UCPDC এবং বৈদেশিক বিনিময় লেনদেন গাইডলাইন ভালভাবে অনুসরণ করতে হবে। একটি এলসি আবেদনপত্রে যেসব বিষয় উল্লেখ করতে হবে –

  • সুবিধাভোগীর নাম ও ঠিকানা

  • বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ

  • ঋণের প্রকৃতি এবং মেয়াদ

  • পণ্যের বিবরণ – পরিমাণ, ইউনিট মূল্য, কোয়ালিটি, এইচ এস কোড ইত্যাদি

  • বিক্রয়ের শর্ত

  • কান্ট্রি অব অরিজিন

  • শিপমেন্ট টার্মস

  • যে দেশ থেকে জাহাজীকরণ করা হবে

  • জাহাজীকরণের তারিখ

  • জাহাজীকরণ পূর্ব নির্দেশনাবলী

LC Application

এর পর আপনাকে একটি Letter of Credit Authorization Form (LCAF) দেওয়া হবে। এই ফরমে থাকা তথ্যগুলো সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে। যেমন আমদানিকারকের ঠিকানা, আইআরসি নাম্বার, পণ্যের বিবরণ, এইচএস কোড ইত্যাদি।

সকল ডকুমেন্ট, আবেদনপত্র এবং এলসিএফ ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে। তারপর বাকি কাজ ব্যাংকের। আপনার দায়িত্ব শেষ।

এলসি সংশোধন

এলসি খোলার পর যদি রপ্তানিকারক বা আমদানিকারক দেখে এলসিতে কিছু অসংগতি আছে বা এলসিতে থাকা কিছু শর্ত পালন করা কষ্টকর হয়ে যাবে তখন এলসি সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে বা নতুন কিছু বিষয় এলসিতে যুক্ত করা হয়।

যদি সুবিধাভোগী দেখেন এলসিতে অসঙ্গতি আছে তাহলে তিনি ক্রেতাকে জানান তারপর ক্রেতা ব্যাংককে অবহিত করেন। অথবা ক্রেতা যদি মনে করে এলসি সংশোধনের প্রয়োজন তখন তিনি তার ব্যাংককে অবহিত করেন। যদি আসন্ন সংশোধনী বিনিময় নিয়ন্ত্রণ আইনের সাথে বা প্রফোরমা ইনভয়েজের সাথে সাংঘর্ষিক না হয় এবং ব্যাংকের স্বার্থের পরিপন্থি না হয় তখন ব্যাংক আপনার আবেদন গ্রহণ করবে।

এলসি সংশোধনী চাওয়ার সময় ব্যাংক আমদানিকারকের কাছে বিভিন্ন তথ্য চাইতে পারে, যেমন –

  • পণ্য পরিবহনের বর্ধিত তারিখ এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ

  • এলসির মূল্য বাড়ছে না কমছে

  • পণ্যরে বিবরণের পরিবর্তনের তথ্য

  • পণ্য পরিবহণের মাধ্যমের পরিবর্তন

  • পণ্য জাহাজীকরণ এবং খালাসের স্থানের পরিবর্তন হবে কিনা

  • এলসির শর্তের পরিবর্তন

  • সরবরাহকারীর পরিবর্তন

  • নতুন কোন শর্তের সন্নিবেশ

এলসি সংশোধন করবেন যেভাবে

এলসি সংশোধনের প্রকৃত কারণ উল্লেখ করে আবেদনপত্র লিখতে হবে।
এলসি সংশোধনের জন্য যদি নতুন ডকুমেন্ট হাতে আসে সেগুলো সাথে জমা দিতে হবে।
প্রফোরমা ইনভয়েজে কোন পরিবর্তন আসলে নতুন প্রফোরমা ইনভয়েজ যুক্ত করতে হবে।

আপনাকে মনে রাখতে হবে মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রাংশের জন্য এলসি সংশোধনী ১৭ মাস পর্যন্ত বৈধ এবং অন্যান্য আমদানির ক্ষেত্রে ৯ মাস পযন্ত বৈধ।

এলসির সুবিধা 

এলসির কিছু সুবিধা আছে। একজন আমদানি-রপ্তানিকারক হিসেবে আপনাকে এলসির সুবিধা সম্পর্কে জানতে হবে। এলসির কিছু সুবিধা হচ্ছে –

  • এলসি রপ্তানিকারকের ঝুঁকি হ্রাস করে। কারণ আমদানিকারক যখন এলসি খুলে তখন রপ্তানিকারকের পেমেন্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে আর কোন বাঁধা থাকে না।

  • এলসি আমদানিকারকের স্বচ্ছলতা নির্দেশ করে। এর ফলে রপ্তানিকারক ক্রেতাকে পণ্য পাঠাতে দ্বিধান্বিত হয় না।

  • এলসির কারণে বিক্রেতা ঠিক সময়ে তার পেমেন্ট পেয়ে যায়।

  • এলসি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা বাড়াতে ব্যাপকভাবে ভূমিকা পালন করে। কারণ এলসির কারণে বিদেশি অপরিচিত ক্রেতার কাছেও নিশ্চিন্তে পণ্য বিক্রি করা যায় এবং পেমেন্ট নিয়ে কোন চিন্তা করতে হয় না।

এলসির অসুবিধা

এলসির কিছু অসুবিধা আছে, সেগুলো হচ্ছে –

  • এলসি বৈদেশিক বাণিজ্যে অতিরিক্ত খরচ যোগ করে।

  • এলসি খোলার প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট জটিল যা বেশিরভাগ ব্যবসায়ী বুঝেন না।

  • এলসি খুলতে বিভিন্ন ধরণের ডকুমেন্ট লাগে যা সংগ্রহ করা একজন ব্যবসায়ীর জন্য যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন।

এলসির নমুনা

কিভাবে এলসি খুলতে হয় এই ব্যাপারে জানলেন। এখন এলসিতে কি কি থাকে এই বিষয়ে ভালভাবে ধারণা দেওয়ার জন্য এলসির নমুনাটি দেওয়া হলো।

এলসি কিভাবে খুলতে হয়?

এলসি কিভাবে খুলতে হয়?

LC Specimen

LC Specimen

এলসি খুলতে কেমন খরচ হয়? 

বৈদেশিক বাণিজ্যে এলসি হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি। ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে এলসির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় বলেই এটি এত বেশি নিরাপদ। আর আমরা সবাই জানি যে ব্যাংকের সার্ভিস ব্যবহার করলে অতিরিক্ত কিছু খরচ হবেই। তাই এলসি খুলতে গেলে আপনাকে বেশ কিছু অর্থ খরচ করতে হবে। খরচের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ডকুমেন্ট সংগ্রহের খরচ, বিভিন্ন ধরণের স্ট্যাম্পের খরচ, ভ্যাট এবং ব্যাংক কর্তৃক ধার্যকৃত কমিশন। ব্যাংকভেদে এই কমিশনের পরিমাণ কম বা বেশি হয়। সাধারণত এলসির মোট মূল্যের ১% এর ভেতরেই এই কমিশন হয়ে থাকে।   ,

পরিশেষে

কিভাবে এলসি খুলতে হয়? আশা করি এই প্রশ্নের উত্তর ভালভাবেই পেয়ে গেছেন। এখন আপনার কাজ হচ্ছে এলসি খোলার জন্য যে কোন একটি ব্যাংকে যাওয়া। তাদের সাথে কথা বলে যেসব বিষয়ে আপনার জানার আছে সেসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা। বিশেষ করে এলসির খোলার জন্য কি পরিমাণ অর্থ খরচ হবে এই বিষয়টা আগেই ভালভাবে জেনে নিবেন।

বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল বাংলাদেশের প্রথম গবেষণাধর্মী একটি বিজনেস ব্লগ। আমরা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইডিয়া, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের লেখা এবং পরামর্শ যদি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে থাকে তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here