চীন থেকে পণ্য আমদানি

আমরা সবাই জানি যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরেই বাংলাদেশ চীন থেকে প্রায় সাড়ে এগারো বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে।  প্রতি বছরই এই আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চীন থেকে পণ্য আমদানি বাড়ার একটা বড় কারণ হচ্ছে চীনের সস্তা পণ্য। আমাদের মত স্বল্প আয়ের দেশের মানুষের কাছে সস্তা পণ্য অধিক জনপ্রিয়। এজন্য আমদানিকারকদের চীন থেকে পণ্য আমদানির প্রতি আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চীন থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশে বেশি আমদানি করা হয় 

আমাদের দেশে চীন থেকে বিভিন্ন ধরণের পণ্য আমদানি করা হয়। এর মধ্যে কিছু কিছু পণ্য পরিমাণে বেশি আমদানি করা হয় আবার কিছু পণ্য আছে যেগুলো খুবই কম পরিমাণে আমদানি করা হয়। চীন থেকে সাধারণত যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তার একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলো-

  • ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য

  • মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল

  • প্রযুক্তি পণ্য

  • মেডিক্যাল সামগ্রী

  • বাচ্চাদের খেলনা

  • বিভিন্ন ধরণের খাদ্যপণ্য

চীন থেকে পণ্য আমদানি করার নিয়ম 

চীন থেকে পণ্য আমদানি করার জন্য আপনাকে কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে আপনাকে আমদানির সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। নিচে চীন থেকে পণ্য আমদানি করার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –

১. আমদানি লাইসেন্স করা 

চীন থেকে পণ্য আমদানি করতে হলে আপনাকে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে আমদানি লাইসেন্স করা। কারণ আমদানি লাইসেন্স ছাড়া আপনি কোন দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে পারবেন না। আমদানি লাইসেন্স সংগ্রহ করার জন্য আপনাকে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর বরাবর আবেদন করতে হবে। আবেদন করার সময় আপনার কিছু ডকুমেন্ট লাগবে যেমন-

  • জাতীয় পরিচয়পত্র

  • টিআইএন

  • ট্রেড লাইসেন্স

  • ব্যাংক প্রত্যয়ন পত্র

  • চেম্বার অব কমার্স বা স্বীকৃত ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য পদের সনদপত্র

  • লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি দ্বারা অনুমোদিত সংঘ স্মারক এবং সংঘবিধি এবং সার্টিফিকেট অব ইনকর্পোরেশন।

আরো পড়ুনঃ ভারত থেকে পণ্য আমদানি করার বিস্তারিত নিয়ম।

২. রপ্তানিকারক খুঁজে বের করা 

একজন আমদানিকারক যখন আমদানি ব্যবসা শুরু করতে চান তখন সবচেয়ে বেশি যে সমস্যার সম্মুখীন হবেন সেটি হচ্ছে একজন ভাল রপ্তানিকারক খুঁজে বের করা। নতুন ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে পুরাতন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে রপ্তানিকারক খুঁজে বের করেন। আবার অনেকে সরাসরি রপ্তানিকারকের দেশে গিয়ে রপ্তানিকারকের সাথে পণ্য ক্রয়ের চুক্তি করেন। তাই আপনি চাইলে সরাসরি চীনে গিয়েও বিক্রেতার সাথে দেখা করে পণ্য বাছাই করতে পারেন।

আলিবাবা হচ্ছে অন্যতম জনপ্রিয় বিটুবি প্লাটফর্ম যেখানে আপনি চীনের প্রায় সব ব্যবসায়ীদের খোঁজ পাবেন। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আপনি একজন বিক্রেতার সব ধরণের তথ্য জানতে পারবেন। তাদের রপ্তানির ইতিহাস এবং সক্ষমতা সম্পর্কে ভাল ধারণা পাবেন। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব যাচাই করার জন্য আলিবাবার ভেরিফিকেশন পদ্ধতি আছে তাই বিক্রেতার অস্তিত্ব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।

বিক্রেতা খুঁজে পেলে তার সাথে আপনি যোগাযোগ করবেন। আপনি আলিবাবা অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিক্রেতাকে মেসেজ দিতে পারেন। আবার চাইলে তাকে মেইল করতে পারেন। যদি স্কাইপে অ্যাকাউন্ট দেওয়া থাকে তাহলে সরাসরি ভিডিও কলে কথা বলতে পারেন। বিক্রেতার কাছ থেকে পণ্য সম্পর্কে সবকিছু জেনে নিবেন এবং দরকষাকষি করে দাম ঠিক করে নিবেন।

৩. স্যাম্পল সংগ্রহ করা

যে কোন পণ্য ক্রয় করার আগে অবশ্যই সেই পণ্যের স্যাম্পল সংগ্রহ করে নিবেন। কারণ ছবিতে যেমন দেখা যায় বাস্তবে অনেক সময় তার মিল পাওয়া যায় না।

আপনাকে অর্থ পরিশোধ করেই স্যাম্পল সংগ্রহ করতে হবে। তবে আপনি যখন বেশি পরিমাণে পণ্যের ক্রয়াদেশ দিবেন তখন বিক্রেতা স্যাম্পলের মূল্য আপনাকে ফেরত দিয়ে দিবে। স্যাম্পল আনার জন্য আপনাকে এয়ার ওয়ে ব্যবহার করতে হবে। DHL, FEDEX, TNT সহ বিভিন্ন মাধ্যম আছে যাদের মাধ্যমে আপনি স্যাম্পল দেশে আনতে পারবেন।

তবে অনেক ক্রেতা আছে যারা আপনাকে ফ্রিতেই স্যাম্পল দিতে রাজি হবে। এক্ষেত্রে তারা আপনার ক্রেডিট রিপোর্ট ভাল করে চেক করবে।

আরো পড়ুনঃ আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন তার গাইডলাইন

৪. প্রফোরমা ইনভয়েজ গ্রহণ করা

প্রফোরমা ইনভয়েজ হচ্ছে এমন একটি পত্র যা রপ্তানিকারক আপনাকে প্রদান করবে। এই ইনভয়েজে সকল প্রকার শর্ত উল্লেখ করা থাকে। যেমন – পণ্যের দাম, পরিমাণ, গুণাগুণ, প্যাকেজিং, যে মাধ্যমে পাঠানো হবে তার বিবরণ, জাহাজীকরণ সংক্রান্ত শর্তাবলী ইত্যাদি।

৫. এলসি করা 

চীন থেকে যদি পণ্য আমদানি করতে চান তাহলে আপনাকে এলসি করতে হবে। প্রফোরমা ইনভয়েজ সংগ্রহ করার পর আপনাকে সেটা নিয়ে ব্যাংকে যেতে হবে। এই ইনভয়েজ দেখে ব্যাংক আপনার এলসি সম্পন্ন করবে।

এলসি করার জন্য প্রফোরমা ইনভয়েজ ছাড়াও বিভিন্ন ডকুমেন্ট লাগে। যেমন-

  • ট্রেড লাইসেন্স

  • টিআইএন ( TIN)

  • বিন (BIN)

  • আইআরসি (I.R.C)

  • জাতীয় পরিচয়পত্র

  • প্রতিষ্ঠান হলে সম্পত্তি এবং দায়ের স্ট্যাটমেন্ট ইত্যাদি।

পণ্য খালাস করা 

এলসি করা হলে গেলে ব্যাংক সেই এলসির ডকুমেন্ট চীনের রপ্তানিকারককে পাঠিয়ে দিবে। রপ্তানিকারক এলসি হাতে পাওয়ার পর পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নিবে। পণ্য তৈরির পর তা জাহাজীকরণ করবে। পণ্য জাহাজীকরণ করার পর সমস্ত ডকুমেন্ট আপনার ব্যাংকে পাঠাবে। যেমন – বিল অব ল্যাডিং, সার্টিফিকেট অব অরিজিন, কমার্সিয়াল ইনভয়েজ, এয়ার/ শিপিং ওয়ে বিল, প্যাকেজিং লিস্ট ইত্যাদি। এসব ডকুমেন্ট আপনার ব্যাংকে আসার পর ব্যাংক আপনাকে সেসব ডকুমেন্ট দিয়ে দিবে। সেসব ডকুমেন্ট নিয়ে আপনি বন্দরে গিয়ে মাল খালাস করবেন।

এলসি করতে কেমন খরচ হয়? 

যে কোন দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হলে সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হচ্ছে এলসি’র মাধ্যমে লেনদেন করা। তাই বেশিরভাগ ব্যবসায়ী পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য এলসিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে।তাই আপনিও যদি এলসিকেই প্রাধান্য দিয়ে এলসির মাধ্যমে চীন থেকে পণ্য আমদানি করতে চান তাহলে আপনাকে এলসির খরচ সম্পর্কে জানতে হবে।

একটি এলসি করতে কি রকম খরচ হবে তা ব্যাংক টু ব্যাংক কিছুটা পার্থক্য হবে। তবে সেই খরচটা এলসি মূল্যের ১-২ শতাংশের মধ্যেই হবে। যেমন আপনি ১ লাখ টাকার পণ্য আনার জন্য এলসি খুললেন তাহলে আপনাকে ১-২ হাজার টাকা ব্যাংকে কমিশন হিসেবে প্রদান করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন স্ট্যাম্প, ষ্টেশনারী আইটেম ফি, ট্যাক্স এবং ভ্যাট বাবদ আরো কিছু টাকা খরচ করতে হবে।

এলসি ছাড়াও কি চীন থেকে পণ্য আমদানি করা যাবে?

আমরা সবাই জানি এলসি আমদানি প্রক্রিয়াকে জটিল এবং ব্যয়বহুল করে ফেলে। এজন্য অনেক নতুন আমদানিকারকের মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে। তাদের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই যে আপনি এলসি ছাড়াও চীন থেকে পণ্য আমদানি করতে পারবেন। আপনি বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ করে এই বিষয়ে একটি চুক্তি করতে পারেন। বিক্রেতা রাজি থাকলে আর কোন সমস্যা নেই। আপনি বিভিন্ন মাধ্যম যেমন ওয়েস্টার্ন মানি, আলি পে, পেপাল, মানি বুকার, স্ক্রিল ইত্যাদি ব্যবহার করে টাকা পাঠাতে পারবেন।

পরিশেষে

আশা করি এই আর্টিকেল পড়ার পর চীন থেকে পণ্য আমদানি কিভাবে করতে হয় সে সম্পর্কে আপনার মনে আর কোন প্রশ্ন থাকার কথা নয়। তারপরও আপনার মনে যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে আপনি আমাদের কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আমরা আমাদের সাধ্যমত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।

বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল বাংলাদেশের প্রথম গবেষণাধর্মী একটি বিজনেস ব্লগ। আমরা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইডিয়া, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের লেখা এবং পরামর্শ যদি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে থাকে তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here