ড্রপশিপিং-ব্যবসা

ড্রপশিপিং ব্যবসা কি?

ড্রপশিপিং ব্যবসা হচ্ছে এমন এক ধরণের ব্যবসা যেখানে একজন ব্যবসায়ী নিজস্ব পণ্য ছাড়াই ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। এই ব্যবসায় কোন ধরণের কাঁচামাল, গুদাম বা প্যাকেজিং এর প্রয়োজন নেই। ড্রপশিপার এখানে তার অনলাইন স্টোরের মাধ্যমে অন্যের পণ্য বিক্রি করে কমিশন লাভ করে থাকে।

কিভাবে ড্রপশিপিং ব্যবসার মডেল কাজ করে?

ড্রপশিপিং ব্যবসায়ে তিনটি পক্ষ থাকে ।
১. উৎপাদক বা সাপ্লায়ার
২. খুচরা বিক্রেতা ( আপনি)
৩. ক্রেতা
এখানে উৎপাদকের কাজ হচ্ছে পণ্য উৎপাদন করা, প্যাকেজিং করা, গুদামজাত করা এবং ক্রেতাকে পণ্য পৌঁছে দেওয়া।
খুচরা বিক্রেতা বা ড্রপশিপার তার অনলাইন স্টোরের মাধ্যমে উৎপাদকের পণ্য প্রদর্শন করে। ক্রেতা অনলাইন স্টোর থেকে পণ্য পছন্দ করে পণ্য ক্রয়ের জন্য অর্ডার করে। তখন খুচরা বিক্রেতা সেই অর্ডার উৎপাদকের কাছে পাঠিয়ে দেয়। উৎপাদক তখন ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

আরও পড়ুন – ই-কমার্স ব্যবসা কি? কিভাবে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন?

ড্রপশিপার কিভাবে আয় করে? 

যিনি ড্রপশিপিং ব্যবসা করেন তাকেই ড্রপশিপার বলে। তাহলে যেহেতু আপনি ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করবেন তাহলে বলা যায় আপনিই ড্রপশিপার।

এই ব্যবসা শুরু করার আগে আপনার মনে এই প্রশ্নটা আসা খুব স্বাভাবিক যে একজন ড্রপশিপার কিভাবে মুনাফা করে। ধরুন আপনি আপনার অনলাইন স্টোরে একটি শার্ট বিক্রি করবেন। আপনি একজন শার্ট বিক্রেতার শার্ট আপনার অনলাইন স্টোরে প্রদর্শন করবেন। শার্ট বিক্রেতার শার্টটির মূল্য হচ্ছে ৫০০ টাকা। কিন্তু আপনি আপনার অনলাইন স্টোরে শার্টের মূল্য উল্লেখ করেছেন ৬০০ টাকা। ক্রেতা শার্ট অর্ডার করার পর আপনাকে ৬০০ টাকা পরিশোধ করবে। আপনি ৫০০ টাকা শার্টের সাপ্লায়ারকে পরিশোধ করবেন আর বাকি ১০০ টাকা আপনার মুনাফা।

ড্রপশিপিং ব্যবসার কিছু পরিসংখ্যান 

  • অনলাইন রিটেইলারদের মধ্যে ২২% – ৩৩% তাদের প্রাথমিক বিজনেস মডেল হিসেবে ড্রপশিপিংকে গ্রহণ করেছে।

  • প্রচলিত ব্যবসার চেয়ে ড্রপশিপিং ব্যবসাতে ১৮.৩৩% বেশি আয় করা যায়।

  • ২০১৮ সালে ড্রপশিপিং মার্কেটের সাইজ ছিল ১০২.২ বিলিয়ন ডলার যা ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ২৮.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে।

  • ২০২০ সালে পৃথিবীতে ডিজিটাল ক্রেতার সংখ্যা ছিল ২.০৫ বিলিয়ন।

  • যেসব ব্যবসায়ীদের নিজস্ব কাঁচামাল রাখার গুদাম রয়েছে তাদের থেকে ড্রপশিপাররা ৫০ শতাংশ বেশি আয় করে।

  • ২০২০ সালে পৃথিবীতে ডিজিটাল ক্রেতার সংখ্যা ছিল ২.০৫ বিলিয়ন।

  • ড্রপশিপিং ব্যবসায় শিপিং অপশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনলাইন ক্রেতাদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ ক্রেতা সেই ড্রপশিপারের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করে যার একাধিক শিপিং আছে।

আরও পড়ুন – ২০২১ সালের জন্য ১০ টি নতুন ব্যবসার আইডিয়া

কিভাবে ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করবেন?

১. ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করা
২. বাজার বিশ্লেষণ করা
৩. সাপ্লায়ার নির্বাচন করা
৪. অনলাইন স্টোর তৈরি করা
৫. ব্যবসার গঠন নির্দিষ্ট করা
৬. ড্রপশিপিং স্টোরের প্রচার করা

১. ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করা

ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করার আগে আপনাকে অবশ্যই একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে। পরিকল্পনা ছাড়া যদি আপনি এই ব্যবসা শুরু করেন তাহলে আপনার ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

প্রথমেই আপনাকে চিন্তা করতে যে আপনি এই ব্যবসা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কিনা। আপনি যদি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে থাকেন তাহলে আপনি সামনে এগিয়ে যাবেন।

ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করার জন্য আপনার একটি অনলাইন স্টোরের প্রয়োজন হবে। কিভাবে একটি আকর্ষণীয় অনলাইন স্টোর তৈরি করা যায় সেজন্য আপনাকে পরিকল্পনা করতে হবে। এজন্য এই বিষয়ে অভিজ্ঞ কারো সাহায্য নিতে পারেন।

যেহেতু আপনাকে সাপ্লায়ারের সাথে চুক্তি করতে হবে সেজন্য ভাল সাপ্লায়ার কোথায় পাওয়া যায় সে ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে।

কিভাবে আপনি ব্যবসাটি পরিচলনা করবেন তার একটি রূপরেখা তৈরি করে নিন। আপনি কোন ধরণের পণ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে চান এবং কারা আপনার টার্গেট গ্রাহক সেটা নিয়ে রিসার্চ করতে হবে। রূপরেখা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারলে ব্যবসায় সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

২. বাজার বিশ্লেষণ করা

যে কোন ব্যবসা শুরু করার আগে বাজার বিশ্লেষণ করা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  আপনি যে বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন সে বাজারের আকার কি রকম, প্রতিযোগিতা কি রকম এবং কারা এই বাজারের বড় খেলোয়াড় এসব বিষয়ে আপনাকে বিশ্লেষণ করতে হবে।

ড্রপশিপিং ব্যবসায় আপনার প্রতিযোগী কারা সেটা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। আপনার প্রতিযোগীদের সক্ষমতা, মার্কেট শেয়ার এবং তাদের ব্যবসার কৌশল সম্পর্কে জানতে হবে। তাদের সাথে আপনি প্রতিযোগিতা করে মার্কেটে টিকে থাকতে সক্ষম কিনা সেটা যাচাই করতে হবে।

প্রতিযোগী সম্পর্কে জানার জন্য আপনি গুগলের সাহায্য নিতে পারেন। আপনি যেসব পণ্য নিয়ে ব্যবসা করতে চান সেগুলো নিয়ে গুগলে সার্চ করতে পারেন। সার্চ রেজাল্টে প্রদর্শিত প্রথম ১০ জন হচ্ছে আপনার সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেও আপনি আপনার প্রতিযোগী সম্পর্কে জানতে পারবেন।

৩. সাপ্লায়ার নির্বাচন করা

ড্রপশিপিং ব্যবসায় সফলতা নির্ভর করে একজন ভাল সাপ্লায়ার নির্বাচন করার উপর। কারণ ভাল সাপ্লায়ার ছাড়া আপনি লাভজনকভাবে ব্যবসা করতে পারবেন না। ধরেন আপনি একজন সাপ্লায়ারের পণ্য আপনার অনলাইন স্টোরে প্রদর্শন করলেন। ক্রেতা সেই পণ্য পছন্দ করে কেনার জন্য অর্ডার করল। আপনি সেই পণ্য সরবরাহ করার জন্য সরবরাহকারীকে বললেন। তখন সে যদি পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় আপনার গ্রাহক থাকবে না। অথবা কম মানসম্পন্ন সরবরাহ করলে আপনি গ্রাহক হারাতে পারেন।

কিছু বিখ্যাত ড্রপশিপিং মার্কেটপ্লেসের নাম জানা থাকলে আপনার জন্য ভাল সাপ্লায়ার পাওয়া সহজ হয়ে যাবে।  এরকম কিছু মার্কেটপ্লেস হচ্ছে –
–  Shopify
– AliExpress
– Flipkart
– Spocket.
– Rakuten
– SaleHoo
– Wholesale2B.
– MegaGoods

এছাড়া আপনি বাংলাদেশি কোন সাপ্লায়ারের সাথে যোগাযোগ করেও ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করতে পারেন।

৪. অনলাইন স্টোর তৈরি করা

ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করার জন্য আপনাকে একটি অনলাইন স্টোর তৈরি করতে হবে। এর মানে হচ্ছে আপনাকে একটি ইকমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করতে হবে। সেখানে আপনি সাপ্লায়ারের পণ্যগুলো ক্যাটাগরি অনুযায়ী সুন্দরভাবে প্রদর্শন করবেন।

ইকমার্স ওয়েবসাইটটি অবশ্যই প্রফেশনাল এবং ব্যবহারকারী বান্ধব হতে হবে যাতে করে গ্রাহকরা আকর্ষিত হয় এবং সহজে পণ্যের অর্ডার করতে পারে। ভাল হোস্টিং নিতে হবে যাতে প্রচুর ট্রাফিক আসলেও সাইট ডাউন না হয়ে যায়।

৫. ব্যবসার গঠন নির্দিষ্ট করা

এই পর্যায়ে এসে আপনার ব্যবসার গঠন নির্দিষ্ট করতে হবে। ব্যবসার গঠন কয়েক প্রকার হতে পারে, যেমন একমালিকানা, অংশীদারি এবং কোম্পানি। আপনি যদি একা ব্যবসা করতে চান তাহলে একমালিকানা ব্যবসা হিসেবে শুরু করতে পারেন। আর যদি অংশীদারি বা কোম্পানি হিসেবে ব্যবসা করতে চান তাহলে নিদিষ্ট নিয়ম মেনে ব্যবসা গঠন করতে হবে।

৬. ড্রপশিপিং স্টোরের প্রচার করা 

যেকোন ব্যবসায় প্রচার বিক্রয় বাড়াতে সাহায্য করে থাকে। ড্রপশিপিং ব্যবসাও এর বাইরে নয়। এই ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে আপনাকে অবশ্যই বিভিন্ন মাধ্যমে আপনার অনলাইন স্টোরের প্রচার করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অবশ্যই অন্যতম একটি মাধ্যম। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনি আপনার স্টোরের প্রচার করতে পারেন।

সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন ( এসইও) আপনার ওয়েবসাইটকে সার্চ রেজাল্টের প্রথম দিকে নিয়ে যেতে পারে। এর ফলে আপনার বিক্রি অনেক বেড়ে যাবে। তাই এসইও এর প্রতি জোর দিতে হবে।

গুগল এডওয়ার্ড এর মাধ্যমেও আপনি সার্চ রেজাল্টের প্রথম দিকে আপনার স্টোরকে প্রদর্শন করাতে পারেন। তবে এর জন্য আপনাকে ভাল পরিমাণে টাকা খরচ করতে হবে।

ড্রপশিপিং ব্যবসার সুবিধা  

ড্রপশিপিং ব্যবসার কিছু সুবিধা আছে, সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলো –

স্বল্প মূলধন 

ড্রপশিপিং ব্যবসা এমন একটি যা আপনি অনলাইনে একটি দোকান খুলেই শুরু করতে পারবেন। এর জন্য আপনার কোন বাহ্যিক দোকান বা পণ্যের প্রয়োজন নেই যার জন্য আপনি খুব কম মূলধন নিয়েই এই ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।

নিজস্ব পণ্য বা গুদামের কোন প্রয়োজন নেই 

সাধারণত ব্যবসা করতে হলে আমাদের নিজস্ব পণ্যের প্রয়োজন হয় এবং সেই পণ্য রাখার জন্য গুদাম লাগে। কিন্তু এই ব্যবসায় আপনার নিজস্ব পণ্য এবং গুদামের কোন প্রয়োজন নেই। আপনি সকল ব্যবসা হবে অনলাইনে। আপনি শুধু আপনার অনলাইন স্টোরের মাধ্যমে অন্যের পণ্য বিক্রি করবেন।

পণ্য পরিবহন করতে হয় না

এই ব্যবসায়ের আরেকটা বড় সুবিধা হচ্ছে আপনাকে ক্রেতার নিকট পণ্য পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হবে না। পণ্য পরিবহনের সকল দায়িত্ব পালন করবে সাপ্লায়ার।

ড্রপশিপিং ব্যবসার অসুবিধা 

এই ব্যবসার যেমন সুবিধা আছে তেমন কিছু অসুবিধাও আছে, যেমন –

ভাল সাপ্লায়ার খুঁজে বের করা কঠিন 

এই ব্যবসার একটি বড় সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আপনাকে একজন ভাল সাপ্লায়ার খুঁজে বের করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় সাপ্লায়াররা সময়মত পণ্য সরবরাহ করে না। আবার করলেও গ্রাহকের অর্ডার অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করে না।

হঠাৎ স্টক শেষ হয়ে যাওয়া 

ড্রপশিপারররা প্রায়ই এই সমস্যা মোকাবিলা করে থাকেন। প্রায়ই দেখা যায় পণ্যের অর্ডার করার পর সাপ্লায়ার বলে তার কাছে সেই পণ্যের স্টক ফুরিয়ে গেছে। তখন গ্রাহক হারাতে হয়।

গ্রাহকের কাছে দায়বদ্ধতা

এই ব্যবসায় মাঝে মাঝে দেখা যায় সাপ্লায়াররা সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করে না বা লো কোয়ালিটির পণ্য সরবরাহ করে বা অন্য কোন উপায়ে প্রতারণা করে থাকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা প্রতারণা করলেও বা অর্ডার অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ না করলেও তারা গ্রাহকের কাছে দায়বদ্ধ থাকে না। সকল দায় এসে পড়বে আপনার উপর।

পরিশেষে 

ড্রপশিপিং ব্যবসা একটি লাভজনক ব্যবসা। এই ব্যবসা করে আপনি প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। এই ব্যবসায় আপনি শুধু দেশের ভেতরের গ্রাহক থেকে মুনাফা অর্জন করবেন না দেশের বাইরে থেকেও ভাল পরিমাণে আয় করতে পারবেন। ড্রপশিপিং মার্কেটপ্লেসের সাহায্যে আপনি খুব সহজেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা পৃথিবীতে ব্যবসা করতে পারবেন। তাহলে আর দেরি কেন? একটি সুন্দর পরিকল্পনা করে শুরু করে দিন ড্রপশিপিং ব্যবসা।

বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল বাংলাদেশের প্রথম গবেষণাধর্মী একটি বিজনেস ব্লগ। আমরা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইডিয়া, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের লেখা এবং পরামর্শ যদি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে থাকে তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here