ফিড মিল

দেশে পোলট্রি শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে পোলট্রি খাবারের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। যার কারণে ফিড মিল ব্যবসার প্রতি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন কোম্পানির পাশাপাশি ছোট ছোট উদ্যোক্তারা পোলট্রি খাবার তৈরির জন্য ফিড মিল ব্যবসায় এগিয়ে আসছেন।

পোলট্রি শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, দেশে পোল্ট্রি খাবারের চাহিদা বছরে ৬.৪ মিলিয়ন টন। প্রতি বছর এই চাহিদা ১২%-১৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছোট বড় ২০০ শতাধিক ফিড মিল প্রতিষ্ঠান পোলট্রি খাবার বাজারে সরবরাহ করছে তারপরও চাহিদার শতভাগ পূরণ করতে পারছে না। তাই এই খাতে নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়ের বিরাট সম্ভাবনা আছে।

ফিড মিলে যেসব কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়  

পোলট্রি ফিড তৈরির জন্য মোট ১১ ধরনের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের প্রয়োজন হয়ে থাকে, সেগুলো হলো –

  • প্রোটিন কনসেনট্রেট,

  • ভুট্টা,

  • লাইম স্টোন,

  • সয়াবিন মিল,

  • রাইস ব্রান,

  • হুইট পলিশ,

  • ব্রয়লার ফিড

  • ফিশ মিল,

  • লেয়ার ফিড

  • মাস্টার্ড অয়েল কেক

  • কর্ন গ্রটেন মিল অন্যতম।

আরো পড়ুনঃ ২০ টি কৃষি ব্যবসার আইডিয়া যা অল্প পুঁজিতে শুরু করতে পারবেন

ফিডের প্রকারভেদ 

হাস-মুরগি, মাছ, গবাদিপশু ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ধরণের ফিড রয়েছে। যেমন –

  • পিলেট ফিড – পোল্ট্রি ফিড, শ্রিম্প ফিড, ডুবন্ত ফিস ফিড ইত্যাদি।

  • এক্সটুডেড ফিডঃ ফ্লোটিং (ভাসমান ) ফিস ফিড, শ্রিম্প ফিড, পেট ফুড ইত্যাদি।

  • টিএমআর বা টোটাল মিক্সড রেশন (গরুর খাবার)

  • কোর্স ফিড – কোর্স ফিডের মধ্যে রয়েছে কেটল ফিড, লেয়ার ফিড ইত্যাদি।

আরো পড়ুনঃ ১৫ টি লাভজনক ডিলারশিপ ব্যবসার আইডিয়া 

ফিড মিল ব্যবসা শুরু করার ধাপসমূহ  

একটি ফিড মিল দেওয়ার আগে আপনাকে কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হবে। এসব ধাপ অনুসরণ করলে আপনি সহজেই একটি ফিড মিল ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। ধাপগুলো নিচে আলোচনা করা হল –

১. বাজার বিশ্লেষণ

ফিড মিল ব্যবসা শুরু করার আগে আপনাকে স্থানীয় বাজার সম্পর্কে জানতে হবে। ধরে নিলাম আপনি একটি জেলায় পোলট্রি ফিড সরবরাহ করবেন এই চিন্তা করে ফিড মিল দিতে চাচ্ছেন। তাহলে আপনার জেলার চাহিদা সম্পর্কে ভালভাবে জেনে নিতে হবে। আপনার জেলায় কোন কোন উৎপাদক পোলট্রি খাবার তৈরি করছে এবং তাদের সক্ষমতা যাচাই করতে হবে। আপনি যদি তাদের মার্কেটের একটা অংশ দখল করতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে ওদের চেয়ে উন্নত খাবার তৈরি করতে হবে এবং পোলট্রি খাবার বিক্রি করে এসব দোকান মালিকদের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।

যদি আপনি পুরো দেশে খাবার সাপ্লাই দিতে চান তাহলে আপনাকে বড় বড় ব্র্যান্ডের সাথে প্রতিযোগিতা করে বাজারে নিজের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে মানসম্পন্ন খাবার উৎপাদন এবং মার্কেটিং কৌশল আপনাকে বাজারে এগিয়ে রাখবে।

২. প্রশিক্ষণ গ্রহণ 

পোলট্রি ফিড মিল প্রতিষ্ঠার আগে আপনাকে ফিড প্রস্তুত এবং ফিড প্রস্তুত করতে যেসব মেশিনের প্রয়োজন সেগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে ভালভাবে জানার জন্য আপনার প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। আমাদের দেশে অনেক উদ্যোক্তা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিড মিল প্রতিষ্ঠা করছে। তাই আপনি চাইলে সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।

তবে আপনার যদি পূর্বে অন্য কোন ফিড মিল কারখানায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে আপনার প্রশিক্ষণের কোন প্রয়োজন নেই। আপনি সরাসরি কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

৩. জমি ক্রয় এবং স্থাপনা তৈরি করা 

একটি ফিড মিল দেওয়ার জন্য আপনাকে কয়েক একরের একটি জমি ক্রয় বা লিজ নিতে হবে। নিজের জমি থাকতে তো আরও ভাল। একটি আদর্শ ফিড মিল তৈরি করার জন্য ৪ থেকে ৫ একরের যায়গা হলে খুব ভাল হয়। তবে ২ থেকে ৩ একর যায়গা হলেও সমস্যা নেই।

এই জমিতে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা তৈরি করতে হবে। মেশিন বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো,  অফিস রুম, শ্রমিকদের থাকার ঘর, গুদাম ঘর, গাড়ি রাখার যায়গা ইত্যাদি অবকাঠামো আপনার প্রয়োজন হবে।

৪. ফিড মিলের জন্য মেশিন ক্রয় 

হাঁস-মুরগিসহ গবাদিপশুর খাবার তৈরি করার জন্য আপনাকে ফিড মিল মেশিন ক্রয় করতে হবে। মেশিন ছাড়া ফিড তৈরি করা সম্ভব নয়। আপনার মিলে কি পরিমাণ খাবার তৈরি করতে চান সেই সক্ষমতার মেশিন ক্রয় করবেন। একেক জনের একেক ধরণের চাহিদা থাকে, কারো ঘণ্টায় ১০০-২০০ কেজি, কারো ঘণ্টায় কয়েক টন প্রয়োজন। সুতরাং আপনার চাহিদা অনুযায়ী মেশিন ক্রয় করবেন।

ফিড মিলের বিভিন্ন ধরণের মেশিন আছে। আপনি যদি চান আধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয় ফিড মিল প্রতিষ্ঠা করবেন তাহলে আপনি আধুনিক মেশিন ক্রয় করতে পারেন। একটি আধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয় মেশিন প্ল্যান্টের দাম সক্ষমতা অনুযায়ী ৪০ লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকার উপর।

কিন্তু প্রচলিত এবং ছোট মেশিনের দাম এত বেশি নয় এগুলোর আপনার হাতের নাগালের মধ্যেই। ক্ষমতা ভেদে একটি পিলেট মেশিনের দাম ৩০ হাজার থেকে ৭-৮ লাখ টাকা হতে পারে।

৫. জনবল নিয়োগ 

মেশিন স্থাপন হয়ে গেলে আপনাকে এই পর্যায়ে কিছু জনবল নিয়োগ দিতে হবে। আপনার ব্যবসায়ের পরিধি অনুযায়ী লোক নিয়োগ করবেন। আপনি যদি একেবারে ছোট পরিসরে শুরু করতে চান তাহলে ২-৩ জন দিয়ে চালাতে পারবেন। কিন্তু বড় পরিসরে ফিড মিল ব্যবসা শুরু করতে চাইলে আপনাকে কিছু বেশি শ্রমিক নিয়োগ দিতে হবে। মার্কেটিং এর জন্য দক্ষ লোক নিয়োগ দিতে হবে এবং হিসাব সংক্রান্ত কাজ করার জন্য অ্যাকাউন্টেন্ট নিয়োগ দিতে হবে। গাড়ি থাকলে গাড়ি চালক লাগবে।

৬. পণ্য বাজারজাতকরণ 

কাঁচামাল সংগ্রহ করে ফিড তৈরি করে আপনাকে সেগুলো বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দিতে হবে। শুধু দোকানে না বিভিন্ন খামারেও আপনাকে যোগাযোগ করতে হবে।

মার্কেটিং এর জন্য দক্ষ জনবল দরকার। কারণ মার্কেটিং এ দক্ষ জনবল আপনার বিক্রি বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। বর্তমান যুগে আপনি যদি মনে করেন আমি মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করি তাই আমার পণ্য এমনিতেই চলবে তাহলে আপনি ব্যবসায়ীক ক্ষতির শিকার হবেন। কারণ আপনি যত ভাল পণ্যই তৈরি করেন না কেন গ্রাহকদের কাছে যদি আপনার পণ্যটি পরিচিত করাতে না পারেন তাহলে আপনার পণ্য বিক্রি হবে না।

আপনার ব্র্যান্ডের পরিচিতির জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করবেন। কারণ আপনি প্রচলিত মাধ্যমে ব্যবহার করে সবার নিকট পৌঁছাতে পারবেন না কিন্তু ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে অল্প খরচে প্রচুর গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পারবেন।

ফিড মিল দিতে খরচ কেমন হবে?  

সব উদ্যোক্তার মনেই এই বিষয়টা সবার আগে আসে। যে কোন ব্যবসা দেওয়ার আগে চিন্তা করেন তার পুঁজি কেমন লাগবে।

একটি ফিড মিল দিতে আপনার কেমন খরচ হবে সেটা আপনার ব্যবসার পরিধি এবং সক্ষমতার উপর নির্ভর করবে। একটি ফিড মিল ব্যবসা শুরু করতে আপনার বড় একটি যায়গা লাগবে। আপনি যদি যায়গা কিনতে চান তাহলে অনেক টাকা লাগবে। নিজের যায়গা হলে টাকা বেঁচে যাবে। আবার লিজ নিলে এলাকা ভেদে একেক রকম টাকা লাগবে। এছাড়া বিভিন্ন স্থাপনা যেমন অফিস, গুদাম, শ্রমিকদের থাকার ঘর (যদি আপনি চান), গাড়ি রাখার যায়গা ইত্যাদি অবকাঠামোর জন্য আপনার খরচ হবে।

মেশিনের জন্যও আপনার ভাল পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। আপনি যদি ছোট পরিসরে ফিড উৎপাদন করতে চান তাহলে ৫০ হাজার থেকে ৭-৮ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। কিন্তু বড় প্লান্ট স্থাপন করতে ৪০ লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকার উপর খরচ হবে।

পরিশেষে

আশা করি পুরো আলোচনা পড়ার পর আপনি ফিড মিল ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন সে সম্পর্কে ভাল একটা ধারণা পেয়েছেন। এখন এই ধারণা কাজে লাগিয়ে একটি সুন্দর পরিকল্পনা করে ফিড মিল ব্যবসা শুরু করে দিতে পারেন।

বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল বাংলাদেশের প্রথম গবেষণাধর্মী একটি বিজনেস ব্লগ। আমরা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইডিয়া, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের লেখা এবং পরামর্শ যদি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে থাকে তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here