সুপারশপ-ব্যবসা

বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে সুপারশপ ব্যবসা শুরু করার অনুমতি প্রদান করে। এর পর থেকেই বাংলাদেশে সুপারশপ ব্যবসার প্রসার ঘটতে শুরু করে। বাংলাদেশের প্রথম সুপারশপ হচ্ছে PQS যা পরবর্তীতে আগোরা কিনে নেয়। বর্তমানে দেশে ১৬০ টি সুপারশপ ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে।

সুপারশপ মানেই হচ্ছে বড় আকারের দোকান যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য একসাথে পাওয়া যাবে। যেহেতু সকল পণ্য একসাথে পাওয়া যায় তাই গ্রাহকরা সুপারশপ থেকে বাজার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাংলাদেশে যখন প্রথম সুপারশপের যাত্রা শুরু হয় তখন ক্রেতা খুব বেশি ছিল না। সমাজের বিত্তবানরাই ছিল তাদের মূল ক্রেতা। কিন্তু বর্তমানে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ার কারণে মধ্যবিত্তরাও সুপারশপ থেকে কেনাকাটা করে থাকে। এর ফলে সুপারশপ মার্কেটের চাহিদা বাংলাদেশে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

কিভাবে একটি সুপারশপ ব্যবসা শুরু করবেন? 

যে কোন ব্যবসা শুরু করার আগে আপনার ট্রেড লাইসেন্স লাগবে। সুপারশপ শুরু করার জন্যও আপনাকে একটি ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। আপনি যদি সিটি কর্পোরেশনের অধীন এলাকায় এই ব্যবসা দিতে চান তাহলে আপনাকে সিটি কর্পোরেশন থেকে সুপারশপের জন্য ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। জেলা শহরে যদি শুরু করতে চান তাহলে পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারেন।

ট্রেড লাইসেন্স পেয়ে গেলে আপনি সহজেই সুপারশপের উদ্যোগ নিতে পারবেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল এবং প্রচুর মানুষের সমাগম হয় এমন একটি জায়গা নির্বাচন করবেন। তারপর দোকান ভাড়া নিয়ে বা নিজের থাকলে নিজের যায়গায় প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শন করার জন্য ভাল মানের রেক কিনতে হবে। মাছ মাংস প্রদর্শন করার জন্য লম্বা ফ্রিজ কিনতে হবে। এছাড়া দোকানের ভেতরটা আকর্ষণীয় করার জন্য ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে ডিজাইন করাতে হবে।

দোকানে পণ্য প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন কোম্পানির ডিলার এবং সাপ্লায়ারদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তারা যাতে নিয়মিত পণ্য সরবরাহ করে এজন্য তাদের সাথে চুক্তি করতে হবে।

আরো পড়ুন – বেকারি ব্যবসা শুরু করবেন কিভাবে? আদ্যোপান্ত জানুন

সুপারশপ মার্কেট দিতে কেমন খরচ হবে?

একটি সুপারশপ ব্যবসা শুরু করতে আপনার কেমন খরচ হবে তা নির্ভর করবে আপনার ব্যবসার পরিধির উপর। আপনি যদি ছোট আয়তনের কোন সুপারশপ দিতে চান তাহলে আপনার খরচ কম হবে আর যদি বড় সুপারশপ দিতে চান তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার খরচ বেশি হবে।

আপনি যদি একটি ছোট আয়তনের অর্থাৎ ৪০০ থেকে ৫০০ বর্গফুটের একটি সুপারশপ দিয়ে চান তাহলে স্থানভেদে দশ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকার প্রয়োজন হতে পারে। আর যদি বড় আয়তন অর্থাৎ ৩ থেকে ৪ হাজার বর্গফুটের একটি সুপারশপ দিতে চান তাহলে ২ থেকে ৪ কোটি টাকা খরচ হতে পারে। এই ব্যাপারে বাংলাদেশ সুপার মার্কেট মালিক সমিতির কিছুদিন আগে এনবিআরের কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করে সেখানে তারা উল্লেখ করে বাংলাদেশে একটি ৪০০০ হাজার বর্গফুটের সুপারশপ ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে সর্বোচ্চ ৪.৫ কোটি টাকা খরচ হয়।

সুপারশপ ব্যবসা শুরু করার আগে যে বিষয়গুলো আপনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে 

সুপারশপের অবস্থান 

সুপারশপ ব্যবসা শুরু করার আগে আপনাকে অবশ্যই একটি সঠিক যায়গা নির্বাচন করতে হবে। সঠিক যায়গা নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি যদি সঠিক যায়গা নির্বাচন করতে না পারেন তাহলে আপনি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন।

সুপারশপ মার্কেটের জন্য এমন যায়গা নির্বাচন করতে হবে যেখানে প্রচুর লোকের জনসমাগম হয়ে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। আশেপাশে বড় কোন সুপারশপের অবস্থান নেই।

অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা এবং কাঠামো 

সুপারশপ-বিজনেস

সুপারশপের জন্য অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা এবং কাঠামো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।গ্রাহকরা যাতে বাইরে থেকে দেখে ভেতরে প্রবেশ করতে উদ্বুদ্ধ হয় এরকম সাজসজ্জা করতে হবে। গ্রাহকদের আকর্ষণ করার জন্য বাহারি রঙে দোকানের ভেতরটা সাজাতে পারেন। পণ্যগুলো তাদের ক্যাটাগরি অনুযায়ী সাজাতে পারেন। যেমন বাচ্চাদের পণ্যগুলো একসাথে, শাকসবজি এবং মাছ-মাংস একই সারিতে, সৌখিন পণ্য একসাথে, রান্নার কাজে ব্যবহার্য জিনিসপত্র একসাথে রাখতে পারেন। এর ফলে গ্রাহকরা সহজেই পণ্যগুলো খুঁজে পাবে।

দক্ষ জনবল

কাস্টমার সার্ভিস দেওয়া এবং সুপারশপ পরিচালনার জন্য অবশ্যই দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। গ্রাহকদের সাথে অবশ্যই ভাল ব্যবহার করতে হবে এবং গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো দ্রুত খুঁজতে সাহায্য করতে হবে।

সকল হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খ রাখার জন্য অ্যাকাউন্টেন্ট নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া বাজেট তৈরি এবং সুপারশপ ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে।

কম্পিউটারাইজড সিস্টেম 

সুপারশপ ব্যবসা পরিচালনার জন্য আপনাকে কম্পিউটারাইজড সিস্টেমের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এজন্য আপনার প্রয়োজনীয় সফটওয়ার লাগবে। এসব সফটওয়ারের মাধ্যমে আপনি খুব দ্রুত হিসাব করতে পারবেন এবং গ্রাহকদের দ্রুত সেবা দিতে পারবেন।

সাপ্লায়ারদের সাথে সুসম্পর্ক 

সাপ্লায়ারদের সাথে অবশ্যই ভাল সম্পর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। যেসব সাপ্লায়ার নিয়মিত পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হবে তাদের সাথে ব্যবসা করা যাবে না কারণ গ্রাহক যদি আপনার দোকানে এসে নিয়মিত পণ্য না পায় তাহলে আপনার গ্রাহক ছুটে যেতে পারে। তাই সাপ্লায়াররা যাতে সময়মত পণ্য সরবরাহ করে এজন্য তাদের তাগাদা দিতে হবে।

আরো পড়ুন – ফিড মিল ব্যবসা শুরু করবেন কিভাবে?

সুপারশপ ব্যবসার চ্যালেঞ্জ 

বাংলাদেশে সুপারশপ ব্যবসার কিছু চ্যালেঞ্জ আছে যেগুলো আপনাকে মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভ্যাট। বাংলাদেশ সরকার সুপারশপগুলোর পণ্যের উপর ৪ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে। অন্যদিকে বাজারের সাধারণ দোকানগুলোর পণ্যের উপর কোন ভ্যাট আরোপ করা হয় নাই। এর ফলে সুপারশপগুলো কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। ভ্যাটের কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক গ্রাহক সুপারশপ থেকে পণ্য ক্রয় করা থেকে বিরত থাকে। আবার মালিক যদি নিজের তহবিল থেকে ভ্যাটের টাকা পরিশোধ করে তাহলে মুনাফার পরিমাণ অনেক কমে যাবে।

সরকারের পক্ষ থেকে সুপারশপগুলোতে নিয়মিত তদারকি করা হয়। বিভিন্ন পণ্যের মান যাচাই করা হয়। তাই এসব দিকে সুপারশপগুলোকে মনযোগ দিতে হয় এবং মান বজায় রাখতে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়।

কিছু পরামর্শ 

সুপারশপ ব্যবসার আইডিয়াটি একটি লাভজনক ব্যবসা। এই লাভজনক ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য আপনি কিছু টেকনিক অনুসরণ করতে পারেন। যেমন –

১. গ্রাহক আকর্ষণ করার জন্য কিছু পণ্যের দামে ছাড় দিয়ে সেটা দোকানের সামনে ব্যানার দিয়ে প্রদর্শন করতে পারেন।

২. খরচ কমানোর জন্য সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে পারেন। বিশেষ করে শাকসবজি কেনার জন্য আপনি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। এর ফলে আপনার খরচ কম হবে। আবার আপনি কম দামে কিনে স্টোরেজ করে রাখতে পারেন। অফ সিজনে আপনি বেশি লাভে বিক্রি করতে পারবেন।

৩. বিক্রি বাড়ানোর জন্য হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে হোম ডেলিভারি চার্জ যতটা সম্ভব কম রাখার চেষ্টা করবেন।

৪. আপনার সুপারশপের পরিচিতি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ইভেন্টের আয়োজন করতে পারেন। স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন এবং প্রচারপত্র বিলি করতে পারেন। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের স্পন্সর হতে পারেন। তবে সেটা অবশ্যই সীমিত পরিসরে করতে হবে যাতে আপনার মুনাফা বেশি কমে না যায়।

৫. আপনার সুপারশপের যখন পরিচিতি বেড়ে যাবে তখন আপনি বিভিন্ন এলাকায় ফ্র্যাঞ্চাইজি দিতে পারেন। এর ফলে যেমন আপনার পরিচিতি বাড়বে তেমনি আপনার মুনাফার পরিমাণও বাড়বে।

আশা করি এই আর্টিকেল পড়ার পর সুপারশপ ব্যবসা সম্পর্কে আপনার ভাল একটা আইডিয়া হয়েছে। এখন আপনি যদি এই ব্যবসা শুরু করতে চান তাহলে উপরে প্রদত্ত পরামর্শগুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি সুন্দর পরিকল্পনা করুন এবং সে অনুযায়ী সামনে এগিয়ে যান। আশা করি আপনি সফল হবেন।

বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল বাংলাদেশের প্রথম গবেষণাধর্মী একটি বিজনেস ব্লগ। আমরা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইডিয়া, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের লেখা এবং পরামর্শ যদি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে থাকে তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here