এক ব্যক্তির কোম্পানি

ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক ব্যক্তির কোম্পানি থাকলেও বাংলাদেশে এতদিন এই সুযোগ ছিল না। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন সংশোধন করে ‘কোম্পানি (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন, ২০২০’ এর গেজেট প্রকাশ করার মাধ্যমে এক ব্যক্তির কোম্পানি পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

এক ব্যক্তির কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যবসা জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। এর ফলে যারা অংশীদার নিয়ে ব্যবসা করতে আগ্রহী না বা উপযুক্ত অংশীদার খুঁজে না পাওয়ার জন্য প্রাইভেট বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না তাদের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল।

এক বক্তির কোম্পানি কি? 

কোম্পানি আইন অনুযায়ী এক ব্যক্তির কোম্পানি বলতে এমন কোম্পানিকে বুঝাবে যে কোম্পানির পরিচালনা বোর্ডে সদস্য থাকবেন কেবল একজন ব্যক্তি।

একজন প্রাকৃতিক সত্তাবিশিষ্ট ব্যক্তি কেবল একটি ওপিসি (ওয়ান পারসন কোম্পানি) গঠন করতে পারবেন। কোম্পানি গঠন করার সময় স্মারকে একজন মনোনীত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করতে হবে।

যদি শেয়ারহোল্ডার মারা যান বা কোম্পানি চালাতে অক্ষম হোন তখন সেই মনোনীত ব্যক্তি কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হবেন। শেয়ারহোল্ডার যদি কখনো মনোনীত ব্যক্তির নাম পরিবর্তন করতে চায় তাহলে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ের (আরজেএসসি) নিবন্ধককে অবহিত করে মনোনীত ব্যক্তির নাম পরিবর্তন করা যাবে। আবার মনোনীত ব্যক্তিও নির্ধারিত পদ্ধতিতে তাঁর সম্মতি প্রত্যাহার করতে পারবেন।

আরো পড়ুনঃ ১০ টি বড় ব্যবসার আইডিয়া

এক ব্যক্তির কোম্পানি প্রতিষ্ঠার শর্তসমূহ

এক ব্যক্তির কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আপনাকে কিছু শর্ত পালন করতে হবে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে –

  • পরিশোধিত মূলধন কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা থেকে অনধিক ৫ কোটি টাকা হতে হবে। অর্থাৎ কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা মূলধন না থাকলে আপনি এই কোম্পানি গঠন করতে পারবেন না।

  • বার্ষিক টার্নওভার ১ কোটি থেকে ৫০ কোটির মধ্যে থাকতে হবে। যদি বার্ষিক টার্নওভার এর বেশি হয়ে যায় তাহলে শর্তপূরণ সাপেক্ষে আপনি প্রাইভেট লিমিটেড বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রুপান্তর করতে পারবেন।

  • একজন প্রাকৃতিক সত্তাবিশিষ্ট ব্যক্তি কেবল একটি এক ব্যক্তির কোম্পানি গঠন করতে পারবেন। কোম্পানির স্মারকে তিনি ছাড়া একজন মনোনীত ব্যক্তির নাম উল্লেখ থাকতে হবে যিনি শেয়ারহোল্ডারে অবর্তমানে (মারা গেলে বা অক্ষম হলে) দায়িত্ব পালনের লিখিত সম্মতি দিবেন।

আরো পড়ুনঃ কিভাবে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করবেন?(একটি কমপ্লিট গাইড)

কোম্পানির পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অন্যান্য শর্তাবলি

  • সীমিতদায়বিশিষ্ট এক ব্যক্তির কোম্পানির নামের শেষে  “এক ব্যক্তির কোম্পানি” বা “OPC” লিখতে হবে।

  • একমাত্র শেয়ারহোল্ডার কোম্পানির পরিচালক হবেন।

  • সংশোধিত কোম্পানি আইনে বলা আছে, এক ব্যক্তির কোম্পানি ব্যবস্থাপনার জন্য কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ব্যবস্থাপক, কোম্পানি সচিব এবং অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারবেন।

  • প্রতি আর্থিক বছরে কমপক্ষে একটি পরিচালক সভা অনুষ্ঠিত হতে হবে।

  • বিশেষ রেজুলেশন এবং কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর বিধান মোতাবেক কোম্পানির স্মারক পরিবর্তন করা যাবে। তবে কোম্পানি স্মারক বা বিধিতে কোন পরিবর্তন আনয়ন করা হলে তা নির্ধারিত পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রারকে অবহিত করতে হবে।

  • কোম্পানির শেয়ার হস্তারন্তর করতে চাইলে শুধুমাত্র একজন প্রাকৃতিক সত্তাবিশিষ্ট ব্যক্তির নিকট শেয়ার হস্তান্তর করা যাবে এবং হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কোম্পানি আইনের ৩৮ এর বিধানাবলি প্রযোজ্য হবে। শেয়ার হস্তান্তের ক্ষেত্রে হস্তান্তরকারীর ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে কমিশনের মাধ্যমে হস্তান্তর দলিলে স্বাক্ষর করতে হবে।

  • শেয়ার হস্তান্তরকারী বিদেশি হলে বা বিদেশে অবস্থান করলে শেয়ার হস্তান্তরের সমর্থনে শেয়ার হস্তান্তর দলিল ও হলফনামা সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রত্যয়ন করে কমিশনের নিকট দাখিল করতে হবে।

  • আর্থিক বছর সমাপ্তির ১৮০ দিনের মধ্যে কোম্পানির আর্থিক বিবরণীর দলিলপত্র যুক্ত করে রেজিস্ট্রারের নিকট দাখিল করতে হবে। আর্থিক বিবরণী অবশ্যই একমাত্র শেয়ারহোল্ডার পরিচালক কর্তৃক স্বাক্ষরিত হতে হবে।

  • কোম্পানি উঠে গেলে পাওনাদারদের ঋণ পরিশোধে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

  • ২১ দিনের নোটিশে বোর্ড মিটিং করা যাবে।

  • এক ব্যক্তির কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংক্রান্ত বিষয়ে বিদ্যমান আইন প্রযোজ্য হবে।

  • কোম্পানি বিলুপ্তির জন্য আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

নিবন্ধন প্রক্রিয়া 

এক ব্যক্তির কোম্পানি প্রতিষ্ঠার জন্য আপনাকে নিয়ম অনুযায়ী যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) বরাবর আবেদন করতে হবে। আবেদন করার জন্য আপনার যেসব ডকুমেন্ট লাগবে সেগুলো হলো –

  • জাতীয় পরিচয় পত্র

  • মোবাইল নম্বর

  • আবেদনকারীর ছবি

  • ইমেইল এড্রেস

  • আবেদনকারীর ই-টিন নম্বর

নিবন্ধন হয়ে যাওয়ার পর ট্রেড লাইসেন্সসহ কোম্পানি গঠনের পরবর্তী ধাপসমূহ যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) কর্তৃক প্রদত্ত নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন করতে হবে।

এক ব্যক্তির কোম্পানি

এক ব্যক্তির কোম্পানির সুবিধা 

এক ব্যক্তি কোম্পানি গঠনের কিছু সুবিধা আছে যা একজন উদ্যোক্তা ভোগ করবেন। এরকম কিছু সুবিধা নিচে আলোচনা করা হলো –

১. যেহেতু এক ব্যক্তির কোম্পানি তাই কোম্পানির সকল প্রাপ্য মুনাফার দাবিদার আপনিই হবেন।

২. কোম্পানি পরিচালনার বিষয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে পারবেন।

৩. অনাকাঙ্ক্ষিত অংশীদার থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন। অনেক সময় দেখা যায় কিছু অংশীদারের অদূরদর্শিতা, খামখেয়ালীপনা বা ব্যক্তি স্বার্থের কারণে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। এর ফলে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এক ব্যক্তির কোম্পানিতে এই সমস্যা থাকবে না।

৪. ব্যবসা পরিচালনায় নিজের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।

৫. সহজেই কোম্পানির গোপনীয়তা রক্ষা করা যাবে।

৬. কোম্পানির আর্থিক বিবরণী এবং আর্থিক রেকর্ডে একমাত্র পরিচালকের স্বাক্ষর থাকতে হয় তাই আর্থিক বিবরণী সঠিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে কিনা তা ভালভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাওয়া যাবে।

অসুবিধা

১. যেহেতু শেয়ারহোল্ডার একজন তাই কোম্পানির সকল বিষয় তাকেই মোকাবিলা করতে হবে।

২. সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হতে পারে। কারণ কয়েকজন অংশীদার থাকলে তাদের মতামত নিয়ে সহজেই আপনি যে সমস্যাটি মোকাবিলা করতে পারতেন তা আপনার একার বিচার বিশ্লেষণে যখন করতে যাবেন তখন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আপনার সমস্যা হতে পারে।

৩. তারল্য সংকটে ভুগতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায় কোম্পানির পণ্যের বিক্রি কমে গেছে বা এক সাথে বড় ধরণের দেনা পরিশোধ করার কারণে তারল্য কমে যায়। যেহেতু আপনার অংশীদার থাকবে না তাই এক্ষেত্রে তারল্য সংকট মোকাবিলা করা আপনার জন্য কঠিন হবে।

৪. যেহেতু আইনে বলা আছে পরিশোধিত মূলধন অনধিক ৫ কোটি টাকা এবং বার্ষিক টার্নওভার ৫০ কোটির মধ্যে থাকতে হবে তাই এই কোম্পানি শুধু ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য প্রযোজ্য। বড় ব্যবসায়ীরা এই কোম্পানির সুবিধা নিতে পারবেন না।

এক মালিকানা ব্যবসা এবং এক ব্যক্তির কোম্পানির মধ্যে পার্থক্য আছে কি? 

আপনার মনের মধ্যে এই ধরণের প্রশ্ন আসা খুব স্বাভাবিক। কারণ দুটি ব্যবসার মালিকানা এক ব্যক্তির নিকট ন্যস্ত থাকে। কিন্তু যদিও মালিকানা এক ব্যক্তির কাছে ন্যস্ত থাকে তবুও এক মালিকানা ব্যবসা এবং এক ব্যক্তির কোম্পানির মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।

প্রধান পার্থক্য হচ্ছে সত্তা। এক মালিকানা ব্যবসায়ের আলাদা কোন সত্তা নেই। কিন্তু এক ব্যক্তির কোম্পানির আলাদা আইনগত সত্তা আছে যা কোম্পানিকে মালিক থেকে পৃথক করে থাকে।

এক মালিকানা ব্যবসায়ের দায় অসীম। কারণ ব্যবসায়ের সকল দায় মালিককে একাই পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু এক ব্যক্তির কোম্পানির দায় সীমাবদ্ধ। শেয়ারহোল্ডার ব্যক্তিগতভাবে কোম্পানির দায় পরিশোধে দায়বদ্ধ নয়।

সারসংক্ষেপ

এক ব্যক্তির কোম্পানি হচ্ছে এমন কোম্পানি যার পরিচালক হবেন একজন।

পরিশোধিত মূলধন কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা থেকে অনধিক ৫ কোটি টাকা হতে হবে।
বার্ষিক টার্নওভার ১ কোটি থেকে ৫০ কোটির মধ্যে থাকতে হবে।

একজন প্রাকৃতিক সত্তাবিশিষ্ট ব্যক্তি কেবল একটি এক ব্যক্তির কোম্পানি গঠন করতে পারবেন।তাঁর একজন মনোনীত ব্যক্তি থাকবে যিনি শেয়ারহোল্ডারের মৃত্যুর পর বা অক্ষম হওয়ার পর দায়িত্ব পালন করবেন।

কোম্পানির নামের শেষে “এক ব্যক্তির কোম্পানি” বা “OPC” লিখতে হবে।

কোম্পানি ব্যবস্থাপনার জন্য কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ব্যবস্থাপক, কোম্পানি সচিব এবং অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারবেন।

বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল বাংলাদেশের প্রথম গবেষণাধর্মী একটি বিজনেস ব্লগ। আমরা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইডিয়া, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের লেখা এবং পরামর্শ যদি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে থাকে তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here