কিভাবে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন

ই-কমার্স মানে হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক কমার্স বা ইন্টারনেট কমার্স। অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম বা ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে ব্যবসা করা হয় তাকে ই-কমার্স ব্যবসা বলে। যেহেতু বাংলাদেশে ইন্টারনেটর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে এবং স্মার্টফোনও অনেক সহজলভ্য তাই ই-কমার্স ব্যবসায়ের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। এজন্য বর্তমানে গৃহিণী থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষ এই ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে।

এছাড়া কোভিড-১৯ ই-কমার্স ব্যবসার জন্য এক বিরাট আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এই মহামারীর সময়ে ই-কমার্স ব্যবসায়ের বাজার কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এর বড় কারণ হচ্ছে করোনা সংক্রমণের ভয়ে মানুষ ঘরের বাইরে কম যাচ্ছে এবং অনলাইনে কেনাকাটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর একটা ইতিবাচক দিক হচ্ছে মানুষের মাঝে অনলাইনে কেনাকাটা করার একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছে যা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে। এর ফলে ই-কমার্সের বাজার আরও বৃদ্ধি পাবে।

ই-কমার্স ব্যবসা কেন করবেন?

বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসায়ের রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। প্রতিনিয়ত এই ব্যবসায়ের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রতিবছরই বাড়ছে ই-কমার্স বাজারের আকার। ই-ক্যাবের তথ্য মতে ২০১৬ সালেও বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের আকার ছিল মাত্র ৫৬০ কোটি টাকা যা ২০২০ সালে ১৬,৬১৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ই-কমার্স খাতের অন্যতম উদ্যোক্তা ফাহিম মাশরুর এর মতে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজার ২৪ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে।

বাংলাদেশে ই-কমার্স মার্কেটের আকার

তারমানে বুঝতে পারছেন কি দ্রুত বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের বৃদ্ধি ঘটছে। এর পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। সর্বশেষ ২০২২ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৭২ লক্ষ যা ২০১৫ সালে ছিল মাত্র ৫ কোটি ৫৪ লাখ।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা

এর ফলে ফেসবুকের ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। নেপোলিয়ন ক্যাট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের বর্তমানে প্রায় চার কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে। ফেসবুক ব্যবহার বাড়ার কারণে  ই-কমার্স আরও বেশি প্রসারিত হচ্ছে।

যেহেতু বাংলাদেশে ই-কমার্সের বিশাল বাজার রয়েছে তাই আপনি চাইলেও এই বাজারের একটা অংশ নিজের দখলে নিতে পারেন। তবে আপনি চাইলেই পারবেন না, এখানে আপনার সক্ষমতার একটা ব্যাপার আছে। আপনি যে পণ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করবেন সেই পণ্য সম্পর্কে আপনার জানাশোনা এবং সর্বোপরি ব্যবসায়ের প্রতি আপনার আগ্রহ ও দক্ষতা থাকলেই আপনি ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করতে পারেন।

আরো পড়ুনঃ ই-কমার্স ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য ১০ টি বিষয় অনুসরণ করুন

কিভাবে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন?

অনেকেই বলবে একটা ওয়েবসাইট আর ফেসবুক পেইজ তৈরি করেই এই ব্যবসা শুরু করে দিতে পারবেন। কিন্তু আমি এত শটকাট ফর্মুলা দিব না। কারণ আপনাকে মনে রাখতে হবে ঝোঁকের বসে কোন কিছু বিশ্লেষণ না করেই কোন ব্যবসায় নামলে সে ব্যবসায় সফল হওয়া যায় না। অবশ্যই সে ব্যবসা শুরু করার কতগুলো ধাপ আছে যেগুলো সফলভাবে পেরোনোর পর আপনি সেই ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।

নিচে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করার ধাপগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলঃ

১. বাজার বিশ্লেষণ করা

২. সঠিক পণ্য নির্বাচন করা

৩. গ্রাহক চিহ্নিত করা

৪. ব্যবসায়ের নাম নির্বাচন এবং লাইসেন্স সংগ্রহ করা

৫. ওয়েবসাইট তৈরি করা

৬. ব্যবসা শুরু করা

১. বাজার বিশ্লেষণ করা

ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করার আগে অবশ্যই আপনাকে বাজার বিশ্লেষণ করতে হবে। বাজার বিশ্লেষণ না করে ব্যবসায়ে নামলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। ই-কমার্সের বাইরে আপনাকে একটি ছোট উদাহরণ দিই। ধরেন আপনি একটি রেস্টুরেন্ট দিবেন। কিন্তু কোন কিছু না ভেবেই এমন এক যায়গায় রেস্টুরেন্ট দিলেন যেখানে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত রেস্টুরেন্ট আছে। যার ফলে আপনি খুব বেশি দিন সেখানে টিকতে পারবেন না।

ঠিক তেমনি ই-কমার্স ব্যবসায় নামার আগে আপনাকে আপনার প্রতিযোগীদের সক্ষমতা যাচাই করতে হবে। আপনার প্রতিযোগী হবে আপনার একই পণ্যের অন্য বিক্রেতারা। তাদের মূলধন, মার্কেট শেয়ার, অবকাঠামো এবং জনবল সক্ষমতার বিপরীতে আপনি টিকতে পারবেন কিনা তা যাচাই করুন।

তবে আপনি যদি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়ে থাকেন এবং ছোট এরিয়াতে ব্যবসা করতে চান তাহলে সেখানকার ব্যবসায়ীদের অবস্থা বিশ্লেষণ করুন। যদি আপনি মনে করেন আপনার উদ্ভাবনী কৌশল বাজার দখল করতে সক্ষম তাহলে এগিয়ে যান।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে ই-কমার্সের সম্ভাবনা ও সমস্যা

২. সঠিক পণ্য নির্বাচন করা

সঠিক পণ্য নির্বাচন করা ই-কমার্স ব্যবসায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন পণ্য নির্বাচন করা উচিৎ যে পণ্য সম্পর্কে আপনার খুব ভাল জ্ঞান আছে। তবে আপনার জানাশোনা পণ্য হলেই হবে না সেই পণ্যের জনপ্রিয়তাও থাকতে হবে।

মানুষ সব ধরণের পণ্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে কিনতে চায় না। একটু ব্যতিক্রমধর্মী সৌখিন বা প্রয়োজনীয় পণ্য মানুষ অনলাইন থেকে বেশি কিনে থাকে। এসব পণ্য সচরাচর মার্কেটে পাওয়া যায় না। কিন্তু বিভিন্ন প্রয়োজনে এসব পণ্য ব্যবহার করেতে হয়। এই ধরণের পণ্য নির্বাচন করতে পারলে আপনার ব্যবসা ভাল হবে।

যে পণ্য নিয়ে ব্যবসা করবেন সেই পণ্যের উৎপাদক কারা সে ব্যাপারে ভাল করে খোঁজখবর নিন এবং তারা আপনার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারবে কিনা তা জেনে নিন।

তবে আপনার বিনিয়োগ যদি অনেক বেশি হয়ে থাকে তাহলে আপনি একই সাথে বিভিন্ন ধরণের পণ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে বিভিন্ন কোম্পানির সাথে চুক্তি করতে হবে।  একই সাথে পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার জন্য কুরিয়ার কোম্পানির সাথে চুক্তি করতে হবে। চুক্তি করা থাকলে আপনি কম খরচে পণ্য ডেলিভারি করতে পারবেন।

আরো পড়ুনঃ ২০২১ সালের জন্য ৮০ টি লাভজনক ব্যবসার আইডিয়া

৩. গ্রাহক চিহ্নিত করা

গ্রাহক চিহ্নিত করা ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করার অন্যতম ধাপ। আপনার পণ্যের গ্রাহক কারা সে ব্যাপারে অবশ্যই ভাল করে ধারণা নিয়ে নিবেন। কারণ সঠিক গ্রাহক চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অনেক ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করার আগে আপনার সম্ভাব্য গ্রাহক কারা তার একটা লিস্ট তৈরি করুন। তাদের জনতাত্ত্বিক শ্রেণিবিন্যাস করুন। যেমনঃ জেন্ডার, বয়স, স্থান ইত্যাদি। প্রকৃত গ্রাহকদের পছন্দ এবং অপছন্দন চাহিদা এবং মনোভাব সম্পর্কে ভাল করে জেনে নিন।

৪. ব্যবসায়ের নাম নির্বাচন এবং লাইসেন্স সংগ্রহ করা

এই পর্যায়ে আপনার ব্যবসায়ের জন্য একটি নাম নির্বাচন করুন। যেকোন ব্যবসায়ের জন্য নাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নাম নির্বাচনের সময় আপনার ব্যবসায়ের পণ্য এবং ধরণের কথা মাথায় রাখতে হবে। ব্যবসায়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাম নির্বাচন করতে হবে যাতে নাম দেখে মানুষ আপনার ব্যবসার পণ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারে। তাই ব্যবসায়ের সাথে প্রাসঙ্গিক একটি নাম নির্বাচন করুন।

আমাদের দেশে ই-কমার্স ব্যবসার জন্য এখনো লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হয় নাই। তবে লাইসেন্স থাকলে আপনার ব্যবসায়ের একটা ভিত্তি থাকবে। আপনার ব্যবসায়ের ব্যান্ড ভেল্যু বাড়বে।  আপনার পছন্দ করা নাম সারাজীবন নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারবেন।

৫. ওয়েবসাইট তৈরি করা

ই-কমার্স ব্যবসা করবেন আর আপনার ওয়েবসাইট থাকবে না তা হতে পারে না। ওয়েবসাইট হচ্ছে আপনার পণ্যের শোকেজ। সেখানে আপনার সকল পণ্য ক্যাটাগরি অনুযায়ী সাজানো থাকবে যাতে গ্রাহকরা খুব সহজে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যটি খুঁজে পেতে পারে এবং ক্রয় করতে পারে।

ই-কমার্স ওয়েবসাইটের জন্য অবশ্যই ভাল হোস্টিং নিবেন যাতে গ্রাহকদের ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ভাল হয়। কারণ আপনার ওয়েবসাইটে প্রচুর ভিজিটর আসবে তখন আপনার ওয়েবসাইটে অনেক চাপ পড়বে। ভাল হোস্টিং না হলে আপনার সাইট ডাউন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে দেশের বাইরে থেকে ভাল কোম্পানির হোস্টিং নিতে পারলে ভাল। যেমনঃ আপনি Bluehost বা Hostgator থেকে হোস্টিং নিতে পারেন। তবে এগুলো একটু ব্যয়বহুল। আর Namecheap থেকে ডোমেইন এবং হোস্টিং নিলে আপনার খরচ খানিকটা কম পড়বে। সার্ভিসের দিক দিয়ে Bluehost বা Hostgator থেকে একটু পিছিয়ে, তবে খারাপ বলা যাবে না। আর যদি দেশের কোম্পানি থেকে নিতে চান তাহলে dianahost থেকে নিতে পারেন। এরা বেসিসের সদস্য এবং দীর্ঘদিন সুনামের সাথে ব্যবসা করছে। তাই তাদের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।

৬. ব্যবসা শুরু করা

এটা হচ্ছে আপনার মূল ধাপ। উপরের সবগুলো সম্পন্ন করার পর আপনাকে ব্যবসা শুরু করতে হবে। এই ধাপে আপনি আপনার পণ্য সংগ্রহ করবেন এবং তা ওয়েবসাইটে আপলোড করবেন। তারপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব পণ্য প্রমোট করবেন।

বাংলাদেশে যেহেতু ফেসবুকের ব্যবহারকারী বেড়েই চলেছে তাই আপনাকে অবশ্যই ফেসবুকে একটা পেইজ তৈরি করতে হবে। সেই পেইজটাকেও প্রমোট করতে হবে। এক্ষেত্রে ফেসবুকে কিছু অর্থ খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। বিজ্ঞাপন ছাড়া আপনি টার্গেট গ্রাহকের কাছে যেতে পারবেন না। আপনি যদি মনে করেন বিজ্ঞাপন ছাড়া ধীরে ধীরে আপনার পেইজটাকে বড় করবেন তাহলে ভুল করবেন। কারণ এতে আপনার দীর্ঘ সময় নষ্ট হবে আর একসময় এভাবে আপনার মধ্যে হতাশা আসতে পারে যা ব্যবসায়ের জন্য খুবই নেতিবাচক বিষয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি গুগলে এডওয়ার্ডেও বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। তবে বাজেট কম থাকলে ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে গ্রাহক ধরে রাখার জন্য গ্রাহকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে এবং সময়মত পণ্যের ডেলিভারি দিতে হবে। পণ্যের গুনাগুণ যাতে ঠিক থাকে সে বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। আপনাকে মনে রাখতে হবে গ্রাহকদের সাথে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক তৈরি করতে চাইলে অবশ্যই ভাল পণ্য সরবরাহ করতে হবে। যদি মনে করেন গ্রাহক ঠকিয়ে বাজে পণ্য সরবরাহ করে বেশি মুনাফা করবেন তাহলে আপনি খুব বেশি দিন এই ব্যবসায় টিকতে পারবেন না।

ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করতে কেমন খরচ হয়?

একজন নতুন ই-কমার্স উদ্যোক্তার মনে এই প্রশ্নটা আসা খুবই যোক্তিক। কারণ খরচ সম্পর্কে যদি ভাল ধারণা না থাকে তাহলে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করা তার জন্য কঠিনই বটে। আসলে এই ব্যবসা শুরু করার জন্য কি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা নির্দিষ্ট করে বলা খুব কঠিন।

খরচের বিষয়টা নির্ভর করবে বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর। পণ্য সংগ্রহ করা এখানে একটা ফ্যাক্টর। আপনি যে পণ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করবেন সেটা যদি আপনার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত হয়ে থাকে তাহলে এখানে কোন অতিরিক্ত খরচ নেই। আবার আপনি যদি পণ্য সরবরাহকারীর সাথে এভাবে চুক্তি করতে পারেন যে আপনার গ্রাহকের অর্ডার অনুযায়ী তারা পণ্য সরবরাহ করবে এবং তারপর পণ্যের দাম নিবে তাহলেও এখানে কোন খরচ নেই।

কিন্তু এমন যদি হয় আপনাকে পণ্য কিনে কোন যায়গা ভাড়া করে স্টক করতে হয় তাহলে অনেক খরচের বিষয় এখানে যুক্ত হবে। যেমনঃ  গুদাম ভাড়া, গুদাম রক্ষকের বেতন, গুদামের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ইত্যাদি।

আপনি যদি একটু বড় পরিসরে এই ব্যবসা শুরু করতে চান তাহলে আপনার একটা অফিস নিতে হবে। সেখানে অফিস পরিচালনা এবং গ্রাহকদের সকল বিষয় দেখাশোনা করার জন্য জনবল লাগবে। পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার জন্য জনবল লাগবে। আর যদি আপনি কুরিয়ারে পণ্য ডেলিভারি দেন তাহলে ডেলিভারি ম্যানের দরকার হবে না।

এখন আসি ওয়েবসাইটের ব্যাপারে। একটি সাধারণ ই-কমার্স ওয়েবসাইট বানাতে ১৫-২০ হাজার টাকার বেশি লাগবে না। আপনার যদি বড় বিনিয়োগ থাকে এবং গ্রাহক সন্তুষ্টির জন্য অনেক ধরণের ফিচার যুক্ত করতে হয় তাহলে লাখ টাকা খরচ করে ওয়েবসাইট বানাতে পারেন। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য এত কিছুর প্রয়োজন নেই। একটি ডোমেইনের দাম পড়বে ৮০০-১০০০ টাকা। কমদামে ডোমেইন কেনার জন্য Namecheap বেস্ট। হোস্টিং এর পেছনে প্রথম দিকে বছরে ২৫০০-৩০০০ টাকা যাবে। তবে ভিজিটর লাখের উপর চলে গেলে হোস্টিং খরচ বাড়াতে হবে। এই হচ্ছে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করার সম্ভাব্য খরচ।

ই-কমার্স ব্যবসা করে কেমন আয় করতে পারবেন?

এই ব্যবসা করে কি পরিমাণ আয় করতে পারবেন তা কতগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করবে, যেমনঃ আপনার পণ্যের দাম নির্ধারণ কৌশল, পণ্য সংগ্রহ করার খরচ, ব্যবসায়ের পরিচালনা খরচ এবং ডেলিভারি খরচ ইত্যাদির উপর।

আপনাকে এমন ভাবে দাম নির্ধারণ করতে হবে যাতে সকল প্রকার খরচ বাদ দিয়েও যোক্তিক পরিমাণ লাভ থাকে। যোক্তিক মুনাফা হচ্ছে যতটুকু মুনাফা করা প্রয়োজন ঠিক ততটুকু মুনাফা করা। অতিরিক্ত মুনাফা করা কখনো ব্যবসায়ের জন্য ইতিবাচক ব্যাপার নয়।

ধরেন আপনি একটা পণ্য বিক্রি করে ৪০ টাকা লাভ করলেন। এখন যদি আপনি দিনে ১০০ পণ্য বিক্রি করতে পারেন তাহলে প্রতিদিন ৪,০০০ টাকা লাভ করতে পারবেন। যদি ৫০ টি বিক্রি করতে পারেন তাহলেও ২,০০০ টাকা লাভ করতে পারবেন। দৈনিক দুই হাজার টাকা লাভ করলেও মাসে ৬০ হাজার টাকা লাভ। আর ভালভাবে অনলাইনে প্রমোট করতে পারলে দিনে কয়েক হাজার টাকা আয় করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। যেহেতু লাভ থেকে অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে নিট লাভ বের করা হয় তাই অন্যান্য খরচ যাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

আপনার পণ্যের দাম নির্ধারণ করবেন কিভাবে?

ই-কমার্স ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে পণ্যের দাম নির্ধারণে গুরুত্ব দিতে হবে। এমনভাবে দাম নির্ধারণ করতে হবে যেন তা আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদের পণ্যের দামের চেয়ে বেশি না হয়। আবার আপনার নিজের মুনাফার দিকেও নজর দিতে হবে যাতে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত না হোন। দাম নির্ধারণ করতে হবে সবকিছু বিবেচনা করে। অনুমান করে দাম নির্ধারণ করলে আপনি প্রত্যাশা অনুযায়ী লাভ করতে পারবেন না। পণ্যের দাম নির্ধারণ করবেন যেভাবেঃ

সকল প্রকার খরচের লিস্ট তৈরি করুন

একটি পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রি করা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের খরচ হয়ে থাকে। যেমনঃ

  • উৎপাদন খরচ

  • বিপণন খরচ

  • গুদাম খরচ

  • পরিবহন খরচ

  • পণ্য ডেলিভারি খরচ

পণ্যের দাম নির্ধারণে এসব খরচ মাথায় রাখতে হবে। ধরেন আপনি ৫০০ পিস শার্ট তৈরি করলেন। দাম নির্ধারণের সময় ৫০০ পিস শার্ট তৈরি করার পর ক্রেতার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত যত খরচ হতে পারে তার একটা লিস্ট তৈরি করুন। তারপর মোট খরচকে ৫০০ দিয়ে ভাগ করে প্রতি পিস শার্টের দাম নির্ধারণ করুন।

লাভের পরিমাণ নির্ধারণ করুন

ধরেন আপনার শার্টের প্রতি পিসের খরচ ৬০০ টাকা। এখন আপনি যদি সল্প সময়ের জন্য যেমন মৌসুমি ব্যবসা করতে চান তাহলে দাম একটু বেশি নির্ধারণ করলেও সমস্যা নেই। কিন্তু সেটা যদি দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসা হয়ে থাকে তাহলে দাম নির্ধারণে আরও কৌশলী হতে হবে। যেমন আপনি যদি দাম একটু কম রাখেন তাহলে সহজেই গ্রাহক ধরে রাখতে পারবেন। আর ভাল পাইকার যদি পেয়ে যান তাহলে কম লাভ করে হলেও সেই পাইকারকে ধরে রাখতে চেষ্টা করুন। আর খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে আপনাকে চিন্তা করতে হবে আপনি দাম কম রেখে বেশি বিক্রি করে লাভ তুলে আনবেন নাকি দাম বেশি রেখে কম পরিমাণ বিক্রি করেই লাভ তুলে আনবেন। সে অনুযায়ী আপনি দাম নির্ধারণ করতে পারেন। আবার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রতিযোগীদের থেকে দাম যেন খুব বেশি না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

ই-কমার্সের সুবিধা ও অসুবিধা

সুবিধাঃ

  • ই-কমার্সের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে আপনি কম খরচে এবং কম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অনেক গ্রাহকের কাছে পৌছতে পারছেন। যা অফলাইনে সম্ভব নয়।

  • ই-কমার্সের কল্যাণে মানুষ এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত পণ্য ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছে।

  • ই-কমার্স কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচিতি এবং তাদের পণ্যের বিক্রয় বাড়াতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে।

  • ই-কমার্স দূরবর্তী ক্রেতার সাথে যোগাযোগের সমস্যা দূর করেছে। ব্যবসায়ীরা এখন অনলাইনের মাধ্যমে খুব সহজেই অন্য অঞ্চলের মানুষকে আকর্ষণ করতে পারছে।

  • ই-কমার্স ব্যবসায়ের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। একজন গ্রাহক ২৪ ঘণ্টাই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পণ্যের অর্ডার করতে পারে।

  • ই-কমার্সের কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযগিতা অনেক বেড়ে গেছে। তাই সবাই ভাল সেবা দিয়ে গ্রাহক ধরে রাখতে চাইছে যা ব্যবসায়ের পরিবেশের উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

  • ই-কমার্স যেকোন দুর্যোগে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যোগান নিশ্চিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে যা আমরা করোনা মহামারীকালে প্রত্যক্ষ করছি।

অসুবিধাঃ 

  • যেহেতু এটি ভার্চুয়াল জগৎ তাই এখানে প্রতারণার সুযোগ বেশি। অনেক প্রতারক গ্রাহকদের ঠকিয়ে পণ্য বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিচ্ছে।

  • গ্রাহকরা সঠিকভাবে পণ্যের গুনাগুণ, সাইজ এবং ব্যবহারবিধি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে না। কারণ অনলাইনে আপনি সেই পণ্যের স্পর্শ বা গন্ধ নেওয়ার সুযোগ নেই।

  • ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কেনার সময় ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় সেসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য অনুমতি না নিয়ে নিজেদের ব্যবসায়ের কাজে লাগাচ্ছে বা তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে দিচ্ছে।

  • বিক্রেতারদের জন্য একটা বড় সমস্যা হচ্ছে অনেক গ্রাহক পণ্য পাওয়ার পর অস্বীকার করে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে চায় না।

  • অনেক সময় কুরিয়ার কোম্পানিগুলো সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে না।

  • গ্রাহকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলে সঠিক সময়ে গ্রাহকের পণ্য পৌঁছানো এবং তাদের যথাযথ সেবা দেওয়া বেশ চেলেঞ্জিং ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

গ্রাহক আকর্ষণ করবেন কিভাবে?

গ্রাহক আকর্ষণ করার উপায়

বর্তমানে ই-কমার্স ব্যবসা খুব বেশি প্রতিযগিতাপূর্ণ। হাজার হাজার উদ্যোক্তা এখন এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। তাই গ্রাহক আকর্ষণ করতে না পারলে আপনার ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

১. ভাল কোয়ালিটির পণ্য বিক্রিঃ আগে একটা সময় ছিল মানুষ শুধু সস্তায় পণ্য ক্রয় করতে চাইত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে তাই বেশিরভাগ মানুষ এখন ভাল কোয়ালিটির পণ্য কিনতে চায়। তাই আপনার পণ্যের গুনাগুণ উল্লেখ করে তা টার্গেট কাস্টমারের কাছে তুলে ধরুন।

২. ডিসকাউন্ট প্রদানঃ গ্রাহক আকর্ষণেরে একটি মনস্তাত্ত্বিক মার্কেটিং কৌশল। পণ্যের দাম একটু বাড়িয়ে ডিস্কাউন্ট দিতে পারেন আবার লাভ একটু কম করে ডিস্কাউন্ট দিতে পারেন। সেটা আপনার বিবেচ্য বিষয়।

৩. ফ্রি ডেলিভারিঃ অনেক গ্রাহক আছে যারা পণ্য কেনার সময় ফ্রি ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চায়। কারণ এরা ডেলিভারি খরচকে অতিরিক্ত বোঝা মনে করে। তাই আপনার লাভ রেখে ফ্রি ডেলিভারির বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, এর ফলে অনেক গ্রাহক সাড়া দিতে পারে।

৪. গ্রাহক বান্ধব ওয়েবসাইটঃ আপনার ওয়েবসাইট গ্রাহক আকর্ষণের জন্য একটা বড় ইস্যু। কারণ একজন গ্রাহক যখন দেখবে আপনার প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটটি প্রফেশনাল এবং গ্রাহক বান্ধব অর্থাৎ খুব সহজেই পণ্য খুঁজে সেই পণ্যের অর্ডার দেওয়া যায় তখন আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হবে।

৫. ফেসবুক পেইজঃ বাংলাদেশে ব্যবসা করার জন্য ফেসবুক পেইজ অবশ্যই থাকতে হবে। যেহেতু ফেসবুকে সব ধরণের গ্রাহকের পদচারণা আছে তাই আপনি সহজেই ফেসবুক পেইজে পোস্টের মাধ্যমে মাধ্যমে গ্রাহক আকর্ষণ করতে পারবেন।

৬. প্রতিযোগিতার আয়োজনঃ সোশাল মিডিয়ায় প্রতিযোগিতার আয়োজন নতুন ক্রেতা আকর্ষণে বড় ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে গ্রাহকদের এনগেজমেন্ট বাড়ে। আর পুরস্কার হিসেবে অবশ্যই আপনার নিজস্ব পণ্য অফার করবেন যাতে আপনার পণ্যের প্রচার বাড়ে।

৭. এসইওঃ সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন নতুন গ্রাহক পাওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। কারণ বেশিরভাগ মানুষ কিছু কেনার আগে গুগলে সেই পণ্য সম্পর্কে সার্চ করে থাকে। তাই আপনার ওয়েবসাইটটি যদি সার্চ ইঞ্জিনের প্রথম পেইজে র‍্যাংকিং করাতে পারেন তাহলে আপনার গ্রাহকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে।

উপসংহার

কিভাবে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন? আশা করি এই আর্টিকেল পড়ার পর এই প্রশ্নের উত্তর ইতোমধ্যে পেয়ে গেছেন। আমি পরামর্শ দিব আপনারা এই ধাপগুলো ভালভাবে অনুসরণ করে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করুন। তাহলে ই-কমার্স ব্যবসায় আপনার সফলতা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে এবং ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাস পাবে।

বাংলাদেশ বিজনেস জার্নাল বাংলাদেশের প্রথম গবেষণাধর্মী একটি বিজনেস ব্লগ। আমরা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন আইডিয়া, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের লেখা এবং পরামর্শ যদি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে থাকে তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হবে।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here